কৃষ্ণসাগর চুক্তি থেকে রাশিয়া সরে যাওয়ায় ব্যাহত হবে বাংলাদেশের গম আমদানি
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে সরে গেছে রাশিয়া। এতে ইতোমধ্যেই নাজুক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের গম ও গম থেকে তৈরি খাদ্যপণ্যের বাজারে বড় ধরনের সরবরাহ সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে সরকার আগের মতোই আশাবাদী অবস্থানে রয়েছে।
ইউক্রেনের বন্দরগুলির ওপর মস্কো পুনরায় অবরোধ না দিলেও– গমের বিশ্ববাজারে ক্ষতি যা হওয়ার তা এরমধ্যেই হয়ে গেছে।
খাদ্য আমদানিকারকরা বলছেন, রাশিয়ার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই অনিশ্চিত গমের বাজারকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে, দাম আরও বাড়বে এবং সরবরাহ কমবে।
রাশিয়া চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার একদিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি গমের দাম ১০-১৫ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশকে বিকল্প উৎসের দিকে ছুটতে হচ্ছে। কিন্তু, এই প্রচেষ্টা অতীতেও তেমন সুফল বয়ে আনেনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. মাহবুবুর রহমান (বৈদেশিক ক্রয়) টিবিএসকে বলেন, 'রাশিয়া থেকে ১ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে(পূর্ব চুক্তির আওতায়); বাকি চালানও সময়মত আসবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে রপ্তানি চুক্তির পরও বেসরকারিভাবে খুব বেশি গম রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে আসেনি'।
মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, কয়েক মাসে বেসরকারি খাতে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ২.৫১ লাখ টন। যদিও বেরসকারি খাতকে ১৪.৯২ লাখ টন আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
গত জুলাইয়ে রাশিয়ার সাথে শস্য আমদানির চুক্তি করে সরকার। এরপর রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় উৎস থেকে গম আমদানি শুরু হয়। এতে স্থিতিশীল হতে শুরু করে, গম-ভিত্তিক আটা-ময়দা ও বেকারি পণ্যের বাজার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) এর তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানির জন্য ১৫.৬৫ লাখ টনের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এই এলসিগুলোর অধিকাংশই ভারত, ইউক্রেন, রাশিয়াতে ও বুলগেরিয়ায় খোলা হয়েছে। এর বিপরীতে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৬.৬৩ লাখ টনের। তবে এই সময়ে বেসরকারিভাবে গম আমদানি হয়েছে ৪ লাখ টনের কিছু বেশি।
সে তুলনায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট গমের আমদানি ছিল ৫৩.৪৩ লাখ টন। এরমধ্যে ১৭% ইউক্রেন থেকে এবং ২১% রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি নেমে আসে ৪০.১২ লাখ টনে।
বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রেদওয়ানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'ইউক্রেন থেকে আমরা গম আমদানি শুরু করেছিলাম, তা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আন্তর্জাতিক বাজারে একদিনের ব্যবধানেই গমের দাম টনপ্রতি ১০-১৫ ডলার বেড়ে গেছে। স্থানীয় বাজারে সরবরাহ একেবারেই কমে যাবে'।
তিনি বলেন, 'গমের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বেকারি, বিষ্কুট ফ্যাক্টরির মালিকরা কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এই সংকট আরও বাড়বে।'
বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, যদি তাদের অন্যতম প্রধান উপাদান আটা-ময়দার-সরবরাহ না থাকে– তাহলে শিল্পটি বন্ধ করে দিতে হবে।
তিনি বলেন, এই সরবরাহ বড় কর্পোরেশনের হাতে ছিল , আর তাদের আমদানিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটলে সরবরাহেও ঘাটতি দেখা দেবে।
"আমাদের এখনও চড়া দামে কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে। আগামীতে আরও অনিশ্চয়তাই দেখছি।"
জালাল উদ্দিন বলেন, যখন কাঁচামালের দাম বাড়ছে, তখন আমরা লোডশেডিংয়ের সমস্যাতেও জর্জরিত। দিনে প্রতি ছয় ঘণ্টার মধ্যে একঘন্টা করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন কমেছে, কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা, দেশে খাদ্য উৎপাদন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বৈঠক করেছে। সেখানে অর্থ, কৃষি, খাদ্য, বাণিজ্য এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
সংকটের আশঙ্কা করছে না সরকার
এদিকে বেসরকারি খাত আমদানিতে হোঁচট খেলেও সরকার রাশিয়া ও বুলগেরিয়া থেকে ৬ লাখ টন গম আমদানির জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) চুক্তি করেছে। এরমধ্যে বুলগেরিয়া থেকে ১ লাখ এবং রাশিয়া থেকে আরও ১ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। বাকিটাও আমদানির প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।
সরকারি সূত্রগুলি জানিয়েছে, আপতত রাশিয়া থেকে গম আমদানিতে কোনো সংকট হবে না বলে মনে করছে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করা গম– আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমদানি সম্পন্ন করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। কারণ, ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে ইউরোপে শীতের প্রকোপ বাড়ার সময়– চলমান বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের পাশাপাশি– যুদ্ধের তীব্রতাও বাড়লে অনেক দেশই গম রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে।
এর আগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিকল্পটি যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তখন দেশের সিংহভাগ শস্য আমদানিতে প্রতিবেশী ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয় বাংলাদেশ। কিন্তু, গত মে মাসে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় নয়াদিল্লি।
এসময় যেসব গম চালানের এলসি আগেই খোলা হয়েছিল– সেগুলি পাওয়ার জন্য কূটনৈতিকভাবে জোরালো উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। এর প্রতিক্রিয়ায়, ভারত সরকারও বাংলাদেশের চাহিদার বিস্তারিত তথ্য চেয়ে সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছিল।
কিন্তু, এরমধ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় শস্য রপ্তানির চুক্তি হওয়ায়- সরকার ও বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা আবারো রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাজারের দিকে ঝোঁকেন, তবে সেটা ছিল কাগজে-কলমে মাত্র।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক তথ্যে দেখা গেছে, চলতি মাসের ২৫ তারিখ সর্বশেষ ৪৬ হাজার ৬৫৫ টন ইউক্রেনের গম নিয়ে একটি জাহাজ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলি জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত থেকেই ৬২ শতাংশ গম আমদানি করা হয়।
বেসরকারি আমদানিকারকরা জানান, এখন বিকল্প দেশ হিসেবে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া থেকে গম আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও দেশগুলো থেকে কতটা গম আমদানি করা যাবে তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
এদিকে একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে আমদানির উৎসও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটের কারণে স্থানীয় মিলগুলো গম ভাঙাতে পারছে না। এতে তাদের ওপর নির্ভরশীল খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাত আরও সমস্যার মধ্যে পড়ছে।
এর আগে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত জুলাইয়ে যুদ্ধরত দেশ দুটির মধ্যে শস্য রপ্তানির চুক্তি হওয়ার পর, ৭ আগষ্ট থেকে ইউক্রেন গম রপ্তানি শুরু করে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের সরবরাহ বাড়ায়, দামও কমতে থাকে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি শুরু করে। অক্টোবর মাসে এস আলম গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ দেশটি থেকে তিনটি চালানে ১.৫৯ লাখ টন গম আমদানি করে।
এ দু'টি গ্রুপসহ খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী আরও বেশকিছু শিল্পগোষ্ঠী ইউক্রেন থেকে গম আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে ৭০-৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। ১০ লাখ টনের কিছু বেশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করেই মেটাতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই আমদানি একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। যেকারণে গম ও গম থেকে তৈরি পণ্যের সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে।