তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি: ফখরুল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দলীয় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীয় নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণাও দেন তিনি। এসময় তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী দলের সমন্বয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণাও দেন।
আজ শনিবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে আয়োজিত বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে এসব ঘোষণা দেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, "আওয়ামী লীগ সরকার এখন ভয় পাচ্ছে। বিএনপির সমাবেশে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ দেখে আওয়ামী লীগ ভয় পেয়ে প্রমাদ গুনছে। ১০ তারিখের সমাবেশ নিয়েও ভয় পেয়েছে। নিজেরাই বলাবলি করছে, সেদিন তখত উল্টে যেতেও পারে। কারণ আ. লীগের নিজের প্রতি আস্থা নাই, জনগণের প্রতিও আস্থা নাই। এজন্য তারা নয়াপল্টনে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিতে চায় না। কিন্তু, আমরা তাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বিএনপি বরাবর পল্টনে সমাবেশ করে আসছ, বিভাগীয় সমাবেশ করেছে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সমাবেশ করেছি। তখন তো কোনো সমস্যা হয়নি।"
তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠে, তখন আওয়ামী লীগ জঙ্গি তৈরি করে বলে- বিএনপি করছে। আবার নিজেরা অগ্নিসন্ত্রাস করে বলে বিএনপি করেছে। কিন্তু, বিএনপি কখনো অগ্নিসন্ত্রাস করেনি, জঙ্গিও তৈরি করে না।
আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উদ্ধৃতি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন- "ওবায়দুল সাহেব বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কোন সংবিধান? নিজেদের ইচ্ছামত, ক্ষমতায় থাকার জন্য, গণতন্ত্রের লেবাস দিয়ে– একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য বারবার কাঁটাছেঁড়া করা হয়েছে– সেই সংবিধান! সেই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা চলতে পারে না। তারা সংবিধানের নাম করে, আইনের নাম করে– অনেক (অনিয়ম) করেছে। কিন্তু, আর করতে দেওয়া হবে না।"
তিনি বলেন, "এবার হাসিনা সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক, নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নিরপেক্ষ সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনে যে সমস্ত দল অংশগ্রহণ করবে এবং তাদের মাধ্যমে একটা পার্লামেন্ট গঠন করা হবে। যে পার্লামেন্টে সকল আন্দোলনকারী দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে। জাতীয় সরকার নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা ও নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। দেশে যতকিছু অসামঞ্জস্য আছে, সমস্যা আছে- সেগুলো নির্ধারণ করে নতুন করে অর্থনীতিকে সজীব করে তুলবে, রাজনৈতিক কাঠামোকে সজীব করে তুলবে।"
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ এবং বিএনপির চলমান আন্দোলনে শরিক হয়ে যারা পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন- তাদের হত্যার বিচার, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানসহ ৩৫ লাখ নেতাকর্মীদের নামে দেওয়া মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এতে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, জনগণের যখন জোয়ার ওঠে– তখন কোনোভাবে তা ঠেকানো যায় না। পরিবহন ধর্মঘট দিয়েও ঠেকানো যায়নি।
তিনি বলেন, এই সরকার তো নির্বাচিত না। এই সরকারের লজ্জাশরম নাই। আমাদের এমন সরকার দরকার- যার লজ্জাশরম থাকবে। আপনারা কার উন্নয়ন করেছেন? ওই ১২ হাজার কোটিপতি না সাড়ে তিন কোটি দরিদ্র মানুষদের? যারা সরকারের সুবিধাভোগী তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অসুবিধা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। এজন্য তারা পরিবর্তনের আশায় বিএনপির সমাবেশে এসেছে।
"আ. লীগ নিজ দলের লোকজনকে সুবিধা দেওয়া ছাড়া জনগণের জন্য কিছুই করেনি। সেই সরকারও থাকবে, এমপি-মন্ত্রীরাও থাকবে– আবার তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে! এটা কখনো মেনে নেওয়া হবে না। জনগণের স্বার্থেই মেনে নেওয়া হবে না"- যোগ করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, বাংলাদেশ একটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। আর সরকার জনগণের টাকা লুট করে মেগা প্রকল্পের নামে বিদেশে টাকা পাচার করছে। এই সমাবেশ দেখে আ. লীগ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, কারণ আপনারা জনগণকে নিয়ে খেলা করছেন।
"এই খেলা বন্ধ করতে হবে। ১০ তারিখের পর থেকে জনগণ আপনাদের নিয়ে খেলবে। ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাতে হবে।"
উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, শত বাধা অতিক্রম করে আপনারা রাজশাহীর এই ময়দানে এসেছেন, দিনের পর খোলা ময়দানে ঘুমিয়েছেন, লক্ষ্য একটাই- গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্র ফেরত এলে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি করতে পারব। আমাদের নেতাকে (তারেক রহমানকে) দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবো।
"এই দেশের সরকার, এই দেশের পুলিশ, যারা দিনের ভোট- রাতে চুরি করে দেয়– তাদের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতেই আমরা সবাই এ সমাবেশে এসেছি।"
এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার দুপুর ২টায় মাদ্রাসা ময়দানের সমাবেশস্থলে পৌঁছান। তারপর থেকেই বক্তব্য দিতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
আগে থেকেই ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানের সমাবেশস্থল পরিপূর্ণ হয়ে যায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ভিড়ে। মাঠের বাইরেও পাঠানপাড়া, ফায়ার সার্ভিস মোড়, ঘোষপাড়া মোড়সহ আশেপাশের সড়কে অবস্থান নেন তারা। থেমে থেমেই স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ।
শনিবার সকাল থেকেই রাজশাহীর জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে খন্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন বিএনপির হাজারো নেতাকর্মী। বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, তারা ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে শহরে প্রবেশ না করে– ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, ভ্যান ও মোটরসাইকেলে চড়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে বিকল্প পথ ব্যবহার করে রাজশাহী শহরে আসেন। কেউ কেউ আসেন নদী ও রেলপথে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন বিকল্প পথ ব্যবহার দিয়ে শহরে আসার পর বিভিন্ন স্থানে জড়ো হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। তারপর স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে করতে সমাবেশস্থলে যান তারা।
নগরীর তালাইমারী মোড়ে পুঠিয়া দুর্গাপুরের কয়েকশ' নেতাকর্মী জড়ো হন।
তাদের মধ্যে দুজন- পুঠিয়ার ভাল্লুকগাছির ইনসান আলী মোল্লা ও আবু বক্কর সিদ্দিক। তারা জানান, ভোরে তারা রওনা দেন সমাবেশস্থলের উদ্দেশ্যে। প্রধান রাস্তা দিয়ে গেলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন বাধা দিচ্ছে। তাই তারা ঘুরপথে গ্রামের মধ্যে দিয়ে ভ্যান ও বাটারিচালিত ইজিবাইকে এসেছেন। এজন্য তাদের অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা লেগেছে।
ভদ্রা মোড়ের মিলন নামের একজন লেগুনা চালাক জানান, যাত্রী নিয়ে শহরের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, আসতে দেওয়া হচ্ছে না।
বিভাগীয় পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাফকাত মঞ্জুর বিপ্লব জানান, বিকেলে বিভাগীয় কমিশনারের আশ্বাসে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।