২ হাজার কোটি টাকার দেনা! শোধ না করেই দেশ ছাড়লেন চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী
দশ ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে দেশত্যাগ করেছেন চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান লস্কর মাহিন।
গত ৬ মার্চ শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে তিনি সপরিবারে দুবাই পাড়ি জমান বলে নিশ্চিত করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ।
এর আগের দিন ৫ মার্চ একটি ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দেয় চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত।
গত এক দশকে চট্টগ্রামের প্রায় ৩৩ জন ব্যবসায়ী দেশ ছেড়েছেন, যাদের কাছের ব্যাংকের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বিদেশ ভ্রমণে আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও দেশ ত্যাগ করা ১৩ জনের তালিকায় সর্বশেষ ব্যক্তি হলেন মাহিন।
মাহিনের বিরুদ্ধে মামলা
২০১৮ সালে গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ নাম দিয়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ নেন মাহিন।
শাখাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গ্রান্ড ট্রেডিংয়ের মোয়াজ্জেম হোসেন ও তার স্ত্রী সাদিকা আফরিনকে দিয়ে এই ঋণ নিয়েছিলেন মাহিন। গত এক বছর ধরে ঋণ গ্রহীতাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকের নথিতে সীতাকুণ্ডের উত্তর সোনাছড়িতে গ্রান্ড ট্রেডিংয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হলেও সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও মিলেনি। ঋণের বিপরীতে এক টাকার কোলাটারেল সিকিউরিটিও নেই।
আদালতের তথ্যমতে, এরপর গত বছরের ১ ডিসেম্বর আশিকুর রহমান লস্করসহ তিন জনের বিরুদ্ধে ১৭৫ কোটি টাকার অর্থঋণ মামলা দায়ের করে ন্যাশনাল ব্যাংক। মামলায় অপর দুই বিবাদী হলেন- মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর স্ত্রী সাদিকা আফরিন।
ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আশিকুর রহমান লস্কর নামে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার আদেশ পাওয়ার পর ২১ মার্চ তার পাসপোর্টটি স্থগিত (স্টপ লিস্ট) করে রাখা হয়েছে।
কিন্তু এর আগেই গত ৬ মার্চ দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন এই ঋণ খেলাপি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতের সেরেস্তাদার মুক্তাদির মাওলানা বলেন, গ্র্যান্ড ট্রেডিং করপোরেশনের তিন কর্ণধারের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার আদেশ গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর, আইজিপি এবং পুলিশ সুপার বরাবর (ইমিগ্রেশন) পাঠানো হয়।
আদালতের আদেশ এবং পাসপোর্ট নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এই দীর্ঘ ব্যবধানের কারণ হিসেবে তিনি প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতা ও কাজের চাপকে দায়ী করেন। এসব ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার জন্য বিশেষ অনুরোধের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, প্রচলিত ব্যাংকিং নিয়ম–কানুন লঙ্ঘন করে ঋণটি বিতরণ করা হয়েছে।
২০১৯ সালে ঋণ বিতরণের পর থেকে কোনো টাকাই আদায় না হওয়ায় আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ কিনা- সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। ঋণ গ্রহীতারা দেশত্যাগ করতে পারেন, এজন্য আদালত তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, "গ্রান্ড ট্রেডিংয়ের এটা ছিল ফোর্স লোন। হেড অফিস, বিশেষ করে ব্যাংকটির কর্ণধারদের (সিকদার গ্রুপ) ম্যানেজ করে এই ঋণ নিয়েছিলেন মাহিন। যেখানে ঋণ বিতরণের কোনো নীতি অনুসরণ করা হয়নি।"
মাহিনের পাওনাদাররা
মাহিনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাহিন এন্টারপ্রাইজের কাছে চার ব্যাংকের ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা, এআরএল শিপ ব্রেকিংয়ের কাছে চার ব্যাংকের ২৮৩ কোটি টাকা এবং গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজের কাছে দুই ব্যাংকের ৫৭৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
মাহিনের কাছে শুধু এবি ব্যাংকরই পাওনা আটকে আছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে মাহিন এন্টারপ্রাইজের কাছে ১ হাজার ১০০ কোটি ও গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজের কাছে পাওনা আছে ৪০০ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল, এবি ও ঢাকা ব্যাংক ছাড়াও মাহিনের প্রতিষ্ঠান মাহিন এন্টারপ্রাইজের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০০ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক পাহাড়তলী শাখার ২৯ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ২৪ কোটি টাকা পাওনা আছে।
এআরএল শিপ ব্রেকিংয়ের কাছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স আগ্রাবাদ শাখার ৭২ কোটি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ১৯ কোটি এবং মেরেডিয়ান ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ১২ কোটি টাকা পাওনা আছে। এছাড়া এআরএল গার্মেন্টেসের কাছে অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখার ১০০ কোটি টাকা পাওনা আটকে রয়েছে।
মাহিনের উত্থান
মাহিনের বাবা জামালপুরের আতিউর রহমান লস্কর। জার্মানভিত্তিক কোম্পানি 'এ্যাকর্ড' এর মেরিন সার্ভেয়ার ছিলেন তিনি।
পেশা থেকে অবসর নিয়ে ২০০০ সালে চট্টগ্রামে ভোগপণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন পর নাম লেখান জাহাজ ভাঙ্গা ব্যবসায়।
পরবর্তীতে তার ব্যবসার হাল ধরেন ছেলে মাহিন।
মাহিন ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়েছেন লন্ডনের মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে। মূলত লন্ডনে পড়ালেখার সুবাধে দেশের বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের মালিকের সন্তানদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন মাহিন। পরে দেশে এসে ব্যবসায়িক জীবনে তার সদ্ব্যাবহার করেন।
এবি ব্যাংকের ঋণ
মাহিন এই সুসম্পর্ক ব্যবহার করে এবি ব্যাংক থেকে নামমাত্র জামানত নিয়ে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বলে জানান ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা।
এবি ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৪ সালে এবি ব্যাংক থেকে প্রথম ঋণ সুবিধা নেন মাহিন। এরপর ২০০৭-০৮ সাল থেকে ধীরে ধীরে বড় অংকের ঋণ সুবিধা নিতে থাকেন।
প্রথম কয়েক বছর ঠিকমতো ঋণ শোধ করলেও ২০১৩-১৪ সালের পর তিনি বড় অংকের কোনো টাকা পরিশোধ করেননি বললেই চলে।
এমনকি খেলাপি হওয়ার পরও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকের শাখাটির কর্মকর্তাদের জিম্মি করে কমান্ডো স্টাইলে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে ঋণ সুবিধা নেন মাহিন।
১৩৩ কোটি টাকা মূল্যের আমদানির সেই ঋণের টাকা গত তিন বছরেও সমন্বয় করেননি তিনি।
সর্বশেষ গত বছর রিসিডিউল করলেও জানুয়ারি থেকে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেন নি মাহিন।
মাহিনের ঋণের বিষয়ে কথা বলতে নারাজ এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে দেশত্যাগ করায় ঋণ আদায়ে শঙ্কিত তারা। কারণ দেড় হাজার কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে শুধু ৫টি ফ্ল্যাট কোলাটেরল সিকিউরিটি রয়েছে। যার আর্থিক মূল্য সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা।
ঢাকা ব্যাংকের ঋণ
ঢাকা ব্যাংকের তথ্যমতে, মাহিনের এআরএল শিপ ব্রেকিং ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার মাধ্যমে ১০টি স্ক্র্যাপ শিপ আমদানি করে।
প্রথম দিকে জাহাজ আমদানি শেষে ঠিক সময়ে ঋণের টাকা শোধ করলেও শেষদিকে কয়েকটি জাহাজের আমদানি মূল্য শোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১৮৫ কোটি টাকা আটকে রয়েছে ব্যাংকের।
গত বছর ঋণটি রিসিডিউল করলেও জানুয়ারি থেকে আবার তিনটি কিস্তি বকেয়া হয়ে গেছে।
এই ঋণের বিপরীতে সীতাকুণ্ডে ১৬০ শতকের একটি ইয়ার্ড, ষোলশহর এলাকায় একটি ভবন ও খুলশিতে ২৬ শতকের একটি জমি বন্ধক রয়েছে। যার মূল্য সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের অভিজাত আবাসিক খুলশীতে রয়েছে মাহিনের একাধিক বাড়ি। এরমধ্যে দুই নম্বর রোডের ১৬/সি নম্বর বাড়িটি প্রথম দিকে নির্মাণ করা। যেখানে বর্তমানে মাহিন এন্টারপ্রাইজের বাণিজ্যিক কাজ পরিচালনা হয়।
সম্প্রতি উত্তর খুলশীর পাঁচ নম্বর রোডে প্রায় ১০০ শতক জমিতে গড়ে তোলেন আরো একটি বিলাসবহুল বাড়ি। যেখানে রয়েছে সুইমিংপুল, জিমনেশিয়ামসহ অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।
নির্মাণ কাজে জড়িত থাকা এক প্রকৌশলী জানান, এই ভবন নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে টেকসই, অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল সামগ্রী।
জমির দাম ও নির্মাণ ব্যয়সহ বর্তমানে এই বাড়ির মূল্য শত কোটি টাকার বেশি।
খুলশির বিজিএমইএ ভবনের তৃতীয় তলায় মাহিনের প্রতিষ্ঠান এআরএল এর অফিস। গতকাল বৃহষ্পতিবার এই অফিসের এক কর্মকর্তার কাছে মাহিনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "উনি (মাহিন) দেশে নেই। কবে ফিরবেন জানি না।"
এদিকে, মাহিনের দুটি ফোন নম্বর এবং হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি।