হাতিরঝিল ভরাট করে চলছে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ
রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া কয়েকশ পুকুর ও জলাধারের মধ্যে টিকে থাকা অন্যতম জলাধার হাতিরঝিলের কারওয়ান বাজারের অংশ ভরাট করছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে এ অংশের ইস্কাটনের বিয়াম ফাউন্ডেশন পর্যন্ত ভরাট করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এ অংশের কাজ নিয়ে আলোচনা ওঠার পরে তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। সোমবারের পর থেকে আর ভরাট করা হচ্ছে না।
তারা জানায়, হাতিরঝিলের এ অংশের পিলার তুলতে লেকের একটি অংশ ভরাট করা হবে। কাজ শেষে ভরাট করা বালু সরিয়ে নেওয়া হবে।
পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক যুগে লেকে মাটি না ফেলেও পিলারের কাজ করা যায়। এভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে জলাধার ভরাট করতে পারে না সরকারি সংস্থা। কাজ শেষে খালি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানে না সংস্থাগুলো।
এছাড়া কাঁঠালবাগান, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, পান্থপথসহ বিভিন্ন এলাকার পানি লেকে এসে জমা হয়; বৃষ্টির সময় এতে বিশৃঙ্খলা ঘটে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার হাতিরঝিলের কারওয়ান বাজার অংশের (হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও) এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রেললাইন থেকে বিয়াম ফাউন্ডেশনের গেট পর্যন্ত লেক ভরাট করে বালু সমান করা হচ্ছে কয়েকটি স্কেভেটর দিয়ে। যদিও লেকের পানির মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে কতটুকু ভরাট করবে। তবে দেখা যায় সীমানার থেকেও কয়েকগুণ বেশি অংশ ভরাট করা হচ্ছে বালু দিয়ে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রো থেকে নিয়োগকৃত এ এলাকার স্টোর অফিসার মাহমুদুল হাসান টিবিএসকে বলেন, পিলার স্থাপনের কাজের জন্য লেকে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। পাইলিং শেষে মাটি আবার সরিয়ে নেওয়া হবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (ডিএই) প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বলেন, "সোমবার হাতিরঝিলের এ অংশের কাজ নিয়ে আলোচনা ওঠার পরে এখন আপাতত কাজ বন্ধ আছে। যা ভরাট করা হয়েছে সোমবার পর্যন্ত। নতুন করে সিদ্ধান্ত আসার পরে কাজ করা হবে।"
তবে মঙ্গলবারও দেখা যায় স্কেভেটর দিয়ে বালু আলগা করে ভরাটের কাজ করা হচ্ছে।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প ও নকশা) এএসএম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, হাতিরঝিলের এ অংশ ভরাটের জন্য লিখিত কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাদেরকে কাজের সুবিধার্থে ছয় মাসের মৌখিকভাবে কিছু অংশ ভরাটের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারা পিলার স্থাপনের কাজ শেষে লেক খালি করে দিবে। এছাড়া লেকের মধ্যে কোনো পিলার বসবে না।
এতো বড় একটি জলাধার ভরাটের ফলে লেকের পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাবে এবং যেসব এলাকার পানি এখানে আসে সেখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে, এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "এর কারণে জলাবদ্ধতা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকারি প্রকল্প চলাকালে এভাবে ভরাট করে কাজ করা যেতে পারে। এটাতো প্রাইভেট কোনো কাজ না।"
এদিকে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, "আধুনিক যুগে যখন নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় পাইলিং করার ক্ষেত্রে, সেখানে হাতিরঝিলের মতো জলাধার ভরাট করে কেন খুঁটি বসাতে হবে? জলাধার সংরক্ষণের কোন আইন মেনে হাতিরঝিল ভরাট করছে সেটা আমার জানা নেই। এভাবে জলাধার ভরাট করতে পারে না।"
তিনি বলেন, "এক্সপ্রেসওয়ের মূল পরিকল্পনায় এ ধরনের ডিজাইন ছিল না যে হাতিরঝিলের উপর দিয়ে এর লাইন যাবে। এ অংশের কাজের মাধ্যমে যেমন লেক ধ্বংস করবে, তেমনি রাস্তাও নষ্ট করবে। আমরা বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে জলাধার ভরাট করতে দেখেছি কিন্তু এভাবে আয়োজন করে জলাধারের এতো বড় একটি অংশ ভরাট দেখিনি। এ অংশ পুনরায় খালি করতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পের নামে যে মেগা অত্যাচার চলছে এর শেষ কোথায় জানা নেই।"
হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পের পরামর্শদের একজন স্থপতি ইকবাল হাবিব টিবিএসকে বলেন, "আমরা মনে করি কনস্ট্রাকশনের জন্য এভাবে ভরাট করতে পারে তবে যে ধরনের নির্দেশনা দেওয়া আছে সেভাবে কাজ করতে পারবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে রাজউক থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে কাজ শেষে লেকের অংশ সেভাবে খালি করে দিতে হবে।"
হাতিরঝিলের এতো বড় একটি অংশ ভরাট থাকলে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "হাতিরঝিল প্রকল্পের কারওয়ান বাজার অংশের সাথে এফডিসি মোড়ে যে কালভার্ট দেওয়া হয়েছে সেটি সুপ্রশস্ত নয়। এখন বৃষ্টির পানি জমে এ অংশ থেকে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। এ অংশের প্রশস্ততা বাড়িয়ে কাজ করলে কিছুটা সমস্যা কমতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এ প্রকল্প শুরু থেকেই সাংঘর্ষিক। এ প্রকল্প আদৌ সুফল বয়ে আনবে কিনা সন্দিহান। এছাড়া এ প্রকল্প হাতিরঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট করবে। তাই উচিত হবে পিলার বসানো শেষ হলেই লেক পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা। শর্ত অনুযায়ী কোনোভাবেই ভরাট করে রাখতে পারবে না।"
গত সোমবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সাথে একটি সভার আয়োজন করেন। ঢাকা মহানগরীতে চলমান সড়ক, রেল ও নৌ পরিবহন অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য গঠিত কমিটির প্রথম সভা ছিল এটি।
সভায় স্টেকহোল্ডাররা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (ডিইই) সড়ক ও রেললাইন বরাবর ছড়িয়ে শহরের বাইরে যাবার কথা থাকলেও বর্তমানে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে র্যাম্প নামানো হচ্ছে, এতে শহরের উপর যানবাহনের চাপ আরো বৃদ্ধি পাবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মতে, বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে তা হাতিরঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট করবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রায় ৪১টি খুঁটি হাতিরঝিল লেকে পড়বে; এতে লেকের সৌন্দর্য বিঘ্নিত হবে বলে দাবি রাজউক প্রতিনিধিদের।