ভয় ও অস্থিরতায় ঢাকা: সোমবারের সমাবেশ ঘিরে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি কার কি পদক্ষেপ
সোমবার (৩১ জুলাই) দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। আওয়ামী লীগও রাজধানীর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছে। এতে করে, শনিবারের মতো আরেক দফা রাজনৈতিক গোলযোগের আশঙ্কা করছে দেশবাসী। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সদস্য মোতায়েন থাকবে।
এর আগে শনিবার রাজধানীর প্রবেশপথগুলোয় অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। পুলিশের অনুমতি না নিয়েই কর্মসূচি পালনকালে যাত্রাবাড়ি, গাবতলী ও ধোলাইখালে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
পুলিশও কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেয়। এসময় যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের অনেকে আহত হন। ১০০ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে আটকও করে পুলিশ।
শনিবারের সহিংসতার ঘটনায় ৭০০ জনের বিরুদ্ধে অন্তত ১৩টি মামলা করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা এমন পদক্ষেপে অটল থাকবেন। অন্যদিকে, এখনও অনুমতির আবেদন না করলেও আগামীকালের সমাবেশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। শনিবারের ঘটনা তাদের বিজয়ের প্রতীক বলেই মনে করছে দলটি।
এদিকে আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে বলেছে, তারা সহিংসতায় উস্কানি না দিলেও, পরিস্থিতির অবনতি হলে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না। ক্ষমতাসীন দল তাদের 'শান্তি সমাবেশ' স্থগিত করলেও সোমবার রাজধানীর ওয়ার্ডগুলোয় অবস্থান কর্মসূচি ও মিছিলের ঘোষণা দিয়েছে।
আ. লীগের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাজধানীর প্রবেশপথগুলোয় অবস্থান কর্মসূচির পালনকালে অরাজকরতার মধ্য দিয়ে বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাসকে ফিরিয়ে এনেছে।
তিনি বলেন, তারা (বিএনপি) আ.লীগের কর্মী ও নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের উপর হামলা করেছে। বাসে আগুনও দিয়েছে। বিএনপি এখন একটি বড় 'নৈরাজ্যবাদী' কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
'আওয়ামী লীগ এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। আমরা এটা হতে দেব না। জনগণের জানমালের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো সতর্ক রয়েছে।'
তিনি বলেছেন, দলের নির্দেশ ছিল কাউকে আক্রমণ না করা। তবে কেউ কোনো ধরনের নাশকতার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। আন্দোলনের নামে বিএনপির কর্মসূচির জবাব দিতে আ.লীগ সর্বদা প্রস্তুত।
আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্য রুখতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত রয়েছে।
প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলের সদস্যরা থাকবে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আহত দলীয় নেতাকর্মী ও নেতাদের দেখতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপির অসৎ উদ্দেশ্যের রাজনীতি ঠেকাতে নির্বাচন পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবে।
তিনি বলেন, 'বিএনপির লক্ষ্য নির্বাচন করা নয়, সংঘাত সৃষ্টি করা এবং দেশকে আন্তর্জাতিক উপকারভোগীদের হাতে তুলে দেওয়া। আমরা জনগণ তা হতে দিতে পারি না।'
'আ.লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকবে এবং বিএনপিকে প্রতিহত করতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে।'
শান্তি সমাবেশ স্থগিত করে আওয়ামী লীগের ঢাকায় মনোনিবেশ করার পদক্ষেপটি বিএনপির ঢাকা কেন্দ্রিক ভাবনা থেকে উদ্ভুত বলে মনে করা হচ্ছে।
ঢাকা-কেন্দ্রিক আন্দোলন জোরদার হবে
বিএনপির এখন পুরো ঢাকাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করছে। দলটি মনে করছে, গত বছরের তুলনায় শনিবারের অবস্থান কর্মসূচিতে তারা বেশি সফল হয়েছে।
বিএনপি নেতারা ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুক্রবারের সমাবেশে যোগ দিতে আসা দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদেরকে সরকারের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত শহর ছেড়ে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী বলেন, 'আমাদের আন্দোলন হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। আমরা প্রয়োজনে কৌশল পরিবর্তন করব, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও। তবে আপাতত আমাদের মনোযোগ ঢাকার দিকে। এবং আমাদের আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, 'গতকালের কর্মসূচিতে আমরা ছোটখাটো ধাক্কা খেয়েছি। তবে মোটামুটিভাবে বলতে গেলে, আমরা দুই প্রান্তে জিতেছি- আমরা জনগণের এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সহানুভূতি পেয়েছি। এটি প্রমাণ করে যে দেশে গণতন্ত্রের কোন জায়গা নেই। সরকার সহিংসতার মানসিকতা নিয়ে আছে এবং এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, 'আমাদের সব দল একমত যে সরকার বদলাতে হবে। আমাদের প্রধান কর্মীরা ঢাকায় থাকবেন, এই পুরো মাস হবে আন্দোলনের মাস এবং এসব দেখাশুনায় আমরা ঢাকায় থাকব।
শনিবার ঢাকার প্রবেশপথে বিরোধী দল বিএনপির পাঁচ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে শেষ হয়।
একটি পুলিশ ভ্যানসহ বেশ কয়েকটি যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা পুলিশি পদক্ষেপের পথ তৈরি করে।
রবিবার (৩০ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গাড়ি পোড়ানোর সঙ্গে তার দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, সরকারি সংস্থার সদস্যরা এমনকি আওয়ামী লীগের ক্যাডাররাও পুলিশের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে এবং মোটরসাইকেলে পালিয়ে যাওয়ার আগে ভিডিও রেকর্ড করেছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীও ঢাকামুখী হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম আগামী ১ আগস্ট ঢাকায় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
আগামীকালের বিক্ষোভে তারা ভূমিকা রাখবে কি না তা এখনো পরিষ্কার নয়।
অনুমতির উপর নির্ভর করে পদক্ষেপ: পুলিশ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, সোমবারের সমাবেশের অনুমতি না পেলে রাজপথে নামতে দেওয়া হবে না।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, 'তারা (বিএনপি) এখনও আবেদন করেনি। তারা অনুমতি পেলে, আমরা সমাবেশের সুযোগ দেব। অন্যথায়, আমরা কোনোভাবেই (সমাবেশ) করতে দেব না।'
ডিএমপি এর আগে শনিবার আ.লীগ ও বিএনপি উভয়কেই রাজধানীতে তাদের কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়নি। বিএনপিও ঘোষণা করেছিল দলটি আর বিক্ষোভের জন্য অনুমতি নেবে না।
এখনও অবধি, পুলিশ সোমবারের জন্য তাদের নিরাপত্তা পরিকল্পনা সম্পর্কে মুখ খুলছে না।
শনিবার বিএনপি অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ করায় শক্ত অবস্থান নেয় পুলিশ। ফলে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার মুখে পড়েন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলীয় নেতাকর্মীরা। গয়েশ্বরকে আটক করা হয় এবং তারপর ছেড়ে দেওয়া হয়, এমনকি ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদ তাকে আপ্যায়নও করেন।
এদিকে শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা পুলিশকে সহায়তা করতে রাস্তায় নেমেছেন।
শনিবারের পুনরাবৃত্তি ঘটার সমস্ত উপাদান এখন মজুত আছে। সম্ভবত আরও বেশিই আছে ।
আপাতত, এই ব্যস্ত শহর উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে।