স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের মাঝে সমন্বয়হীনতা ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়িয়ে তুলছে: বিশেষজ্ঞ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,"ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের মাঝে সমন্বয়হীনতা বিদ্যমান যা ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ভয়াবহ দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ডেঙ্গু বিস্তার প্রতিরোধ ও ডেঙ্গু নিরাময় নিশ্চিতে এই দুই সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূরীকরণ অতীব জরুরী।"
রবিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) উদ্যোগে আয়োজিত 'পরিবেশ ও সামাজিক অভিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গুর প্রসার' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞগণ এসব কথা বলেন।
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, "দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ২০০০ সাল থেকে। কিন্তু এত বছরেও কোনো অভিজ্ঞতা হলো না। আমাদের স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে এসব বাহকবাহিত রোগ আরও বাড়বে। এজন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান দরকার। আমাদের এই মুহূর্তে হটস্পট চিহ্নিত করে ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। আমরা ব্যানার নিয়ে ঘুরছি, রোড শো করছি কিন্তু কোনো লাভ হবে না যদি মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে না পারি। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিটি ফ্ল্যাটে দেখতে হবে মশা জন্ম নিচ্ছে কিনা, সাথে সাথে মানুষকে সচেতন করতে হবে।"
আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রভাব আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন এবং ম্যাপিং করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, "আমাদের ডেঙ্গুবিষয়ক আলোচনা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। সারা দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করতে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশার কামড় থেকে পৃথক করা যাচ্ছে না। সরকার যে তথ্য দিচ্ছে, তা ১২ ভাগের ১ ভাগ। সরকারের হিসাব থেকে রোগীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি। এখন যেখানে ৩০০ মৃত্যু দেখাচ্ছে বাস্তবে তা তিন হাজারের বেশি। পাশের দেশ ভারতের কলকাতা যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার একটি পদক্ষেপও আমরা নিইনি।"
তিনি আরও বলেন, "ডেঙ্গু কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে দেশে, তার ওপর ন্যূনতম কোনো গবেষণা সরকারের পক্ষ থেকে হয়নি। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কী করছে?"
সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপনে বাপার সহ সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের ওপর অত্যাচারের প্রভাবে ডেঙ্গুর এই বিস্তার। সরকারের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে গা-ছাড়া ভাব আছে, ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না। সরকারের মধ্যে সমন্বিত কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। এমনকি দুই সিটির মধ্যে সমন্বয় নেই। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও সঠিকভাবে হয় না।"
ইকবাল হাবিব বলেন, "ঢাকায় যেভাবে সড়ক হয়েছে, তাতে সড়ক উঁচু হয়েছে এবং বাড়িগুলো নিচু থেকে যাচ্ছে। ফলে সেখানে পানি জমছে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর হটস্পট যে জায়গাগুলো, সেখানে রাস্তা অনেক উঁচু। তিনি সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরকে কাজে লাগানোর কথা বলেন।"
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, "ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো রাজনৈতিক কারণ ছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় না।"
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, "ঢাকায় কোনো জনস্বাস্থ্য কাঠামো নেই। ফলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই সব হচ্ছে। এ জন্য হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত করতে হবে।"
মুশতাক হোসেন বলেন, "ডেঙ্গুতে মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। এটা করোনার মতো নয়। এটা কেন ঠেকাতে পারব না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যয় বাড়াতে হবে। এত দিনে একটা নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করা যায়নি, যা করোনার সময়ে ছিল। এখানে স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে একটা নীরব যুদ্ধ আছে। প্রচারের বাইরেও সমাজের মানুষকে সক্রিয় করতে হবে।"
সভায় বাপা'র পক্ষ থেকে দেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনতিবিলম্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণসহ বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।