বোরো মৌসুমের চাহিদা মেটাতে গ্যাস, অর্থ সংকটেও ইউরিয়া কারখানা খোলার চাপে সরকার
আগামী ডিসেম্বর থেকে শুরু যাওয়া বোরো মৌসুমে ইউরিয়া সারের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি সার কারখানায় বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ আছে, অন্যদিকে ডলার সংকটের কারণে আমদানির মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণ নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা।
এ অবস্থায় সংকট এড়াতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) অবিলম্বে এই তিনটির মধ্যে দুটি কারখানায় উৎপাদন চালু করতে চায়। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধও করেছে।
বিসিআইসির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিসিআইসির অধীন চারটি সার কারখানা-ই পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে সক্ষম, এরমধ্যে তিনটি কারখানা বন্ধ থাকায় চলতি বছর স্থানীয়ভাবে ১০ লাখ মে. টন ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারখানা বন্ধ রাখায় উৎপাদনে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
এই অবস্থায়, দরপত্রের মাধ্যমে ২ লাখ টন সার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিআইসি। কিন্তু, চলমান ডলার সংকটের মধ্যে এ পরিমাণ আমদানি করা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। বিশেষত, বোরোর পিক সিজন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে যদি এ আমদানি হয়।
বাংলাদেশের চাল উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বোরো মৌসুম। এসময় প্রায় ২.২৫ কোটি টন চালের উৎপাদন হয়। তাই এসময়ে ধান চাষে যেকোনো ধরনের সমস্যা– দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
এযাবৎকালের সর্বনিম্ন মজুদ
গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিসিআইসিতে ইউরিয়া সারের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি সভা হয়। এই সভায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পিক সিজন শুরুর ডিসেম্বর মাস থেকেই সারের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। আগের কোনো বছরেই আসন্ন পিক সিজনের মতোন এত কম মজুদ ছিল না।
সভায় বলা হয়, এ বছর সার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যথাসময়ে এলসি খোলা ও সারের মূল্য পরিশোধ করতে না পারা, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিসহ বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে এটি নির্বাচনের বছর। এ কারণে সারের পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তোলা জরুরি বলেও গুরুত্ব দেওয়া হয় সভায়।
ফলে আমদানির চেষ্টার পাশাপাশি, জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ থাকা দুটি সার কারখানা – চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এবং যমুনা ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড – চালু করতে চাইছে বিসিআইসি।
কারখানা চালু করতে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বিসিআইসি। ঐদিনই শিল্প মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি তুলে ধরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের অনুরোধ করে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'আমরা টেন্ডারের মাধ্যমে দুই লাখ টন সার সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একইসঙ্গে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করে বন্ধ কারখানা চালু করার বিষয়ে আলোচনা করে যাচ্ছি।'
এর আগে, ২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির কমিশনিং এর জন্য যমুনা ফার্টিলাইজারে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় পেট্রোবাংলা। কোম্পানিটি এর আগেও ছয় মাস গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ ছিল, যা পরবর্তীতে গত ডিসেম্বরের ১০ তারিখ চালু করা হয়েছিল।
এছাড়া পেট্রোবাংলা গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করার কারণে গত বছরের নভেম্বরে চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং এ বছরের মার্চে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। অথচ উভয় কারখানাই উৎপাদনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই অর্থবছরে দেশে ২৭ লাখ টন ইউরিয়ার চাহিদা রয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা মজুদ হিসেবে আরও ৬ লাখ টন সারের সার্বক্ষণিক মজুদ থাকতে হয়। এই চাহিদার বিপরীতে, স্থানীয়ভাবে ১০ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিসিআইসির হিসাব অনুযায়ী, আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে চাহিদা পূরণের পর ডিসেম্বর শেষে নিরাপত্তা মজুদ দাঁড়াবে ৬.২৭ লাখ টন, জানুয়ারি শেষে ৫.০৪ লাখ টন, ফেরুয়ারি শেষে ৩.৭৬ লাখ টন এবং মার্চ শেষে ৩.৯৪ লাখ টন।
অর্থাৎ, বর্তমান অবস্থায় ডিসেম্বরের চাহিদা মেটাতে পারলেও জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত সময়ে সংকট তৈরি হবে।
এই পরিস্থিতি জানিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়কে বিসিআইসি একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ হওয়া অন্তত দুটি ইউরিয়া কারখানায় গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানায়।
সংকটের এই তথ্য গত বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় তুলে ধরেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, এবং বন্ধ কারখানা চালুর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন।
ফেব্রুয়ারির আগে আমদানিও সম্ভব নয়
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সার আমদানি করে সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্ত করা ফেব্রুয়ারির আগে সম্ভব হবে না। এছাড়া এলসি খুলতে দেরি হলে এটা পিক সিজনে কোন কাজেই আসবে না।
বিসিআইসি বলছে, তাদের সবগুলো কারখানাই উৎপাদনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। আসন্ন সংকট মোকাবিলার একমাত্র পথই হচ্ছে কারখানা চালু করা।
আমদানি ও উৎপাদন থেকে জানুয়ারিতে সরবরাহ লাইনে সার থাকবে ৩ লাখ টন। বিসিআইসি বলছে, এই সময়ে অতিরিক্ত আরও দুই লাখ টন ইউরিয়া সারের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে বন্ধ কারখানাগুলোর অন্তত দুটি কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে হবে।
বর্তমানে শুধু শাহজালাল ফার্টিলাইজার কারখানা উৎপাদনে রয়েছে। কারখানাটি দৈনিক প্রায় ১,৪০০ টন সার সরবরাহ করছে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বিসিআইসি'র সভায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব দীপক কুমার চক্রবর্তী জানান, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। বিসিআইসিকে প্রতিদিন ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়। এর মধ্যে ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের জন্য ৭২ এমএমসিএফ ও কাফকোর জন্য ৪৮ এমএমসিএফ দেওয়ার পরে, আরও গ্যাস সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই।
তবে অন্তত আরও একটি কারখানায় গ্যাস সরবরাহ দেয়া যায় কিনা তা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
জিটুজি ব্যবস্থায় ৯০ হাজার টন ইউরিয়া আমদানির চেষ্টা
বিসিআইসির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সভায় বলেন, কোটেশন টেন্ডারের মাধ্যমে দুই লাখ টন ইউরিয়া আমদানির পাশাপাশি নিশ্চিত উৎস থেকে জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) চুক্তির মাধ্যমে ৯০ হাজার টন ইউরিয়া আমদানির চেষ্টা করা হবে।
আমদানির মূল্য পরিশোধের জটিলতা
সভায় সারের আমদানি মূল্য পরিশোধে বিদ্যমান জটিলতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে ছাড় না করায় দৈনিক সুদের কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ দায় বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অপারগতা প্রকাশ করছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাহিদা মাফিক ডলার না পাওয়ার কারণে সারের মূল্য ও জাহাজ ভাড়া পরিশোধে জটিলতা বাড়ছে। এতে করে, শিডিউল মোতাবেক সার আমদানি বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে সভায় অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি জানান, তহবিল অপর্যাপ্ত থাকার কারণে যথাসময়ে ভর্তুকির টাকা ছাড়ে দেরি হচ্ছে।