প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাঁধভাঙ্গা হাসি! সিলেটে বিনামূল্যে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের অস্ত্রোপচার
হাসি যেন থামছেই না বুরহান উদ্দিনের (৫)। হাসপাতালের করিডোরে মায়ের কোলে বসে হেসেই চলছে বুরহান তা দেখে মায়ের মুখেও হাসি।
বুরহানের মা সামিরা বেগম বলেন, "আমার ছেলেকে কখনো এভাবে হাসতে দেখিনি। ঠোঁটকাটা রোগের কারণে সে হাসতে পারতো না। টাকার অভাবে এতোদিন অস্ত্রোপচারও করাতে পারিনি। এখানে টাকা ছাড়াই অস্ত্রোপচার করাতে পেরেছি। এখন আমার ছেলেটার মুখে হাসি ফুটেছে।"
গত বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজের সামনে গিয়ে বুরহান আর তার মায়ের হাসির সাথে সাক্ষাৎ। পাশেই ১১ বছরের মেয়ে সিদ্দিকা বেগমকে নিয়ে বসেছিলেন নাজমা বেগম। হাসিমুখে খুনসুটিতে মেতে আছেন মা-মেয়ে।
নাজমা বেগম জানান, তার স্বামী সিরাজ উদ্দিন কৃষি কাজ করেন। তাদের মেয়ের তালুকাটা। টাকার অভাবে এতোদিন অস্ত্রোপচার করাতে পারেননি। এবার বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করে সফল হয়েছে। এতে তার মেয়ের মুখেও হাসি ফিরেছে।
কেবল বুরহান আর সিদ্দিকাই নন, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার শেষে এভাবে হাসি ফুটেছে ৬৯ জনের মুখে।
মার্কিন বেসরকারি সংস্থা রোটোপ্লাস্ট'র উদ্যোগে বিনামূল্যে ঠোঁট কাটা, তালুকাটা এবং প্লাস্টিক সার্জারির হয়েছে হাসপাতালটিতে। এতে আর্থিক সহায়তা করেছে বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান শেভরন। আর পুরো আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় ছিল রোটারি ক্লাব অব জালালাবাদ।
দশ দিনব্যাপী এই সপ্তম রোটোপ্লাস্ট মিশনে অংশ নেন আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও মিশর থেকে আসা রোটাপ্লাস্ট ইন্টারন্যাশনেলের ১২ জন চিকিৎসক, ৬ জন নার্স, একজন থেরাপিস্ট ও একজন কোভিড সেইফটি অফিসারসহ সর্বমোট ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদল। সিলেটে টানা অবস্থান করে বিনামূল্যে রোগীদের অস্ত্রোপচার করেন তারা।
দুই বছর বয়সের ঠোঁটকাটা শিশু নুসরাত জান্নাতকে নিয়ে তার বাবা গাড়িচালক মানিক মিয়ার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে এ কর্মসূচিতে। শিশুটিকে কোলে নিয়ে মানিক বলেন, "গাড়িচালিক হওয়ায় মেয়ের অস্ত্রোপচার করানোর জন্য টাকা জোগাতে পারছিলেন না। বিনামূল্যে মেয়ের ঠোঁটকাটার অস্ত্রোপচার করায় তিনি খুশি। মেয়ে এখন হাসতে পারবে।"
আয়োজকরা জানান, এই মিশনে একজন আগুনে দগ্ধ রোগী ছিলেন। বাকিরা ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা এবং জোড়া আঙুলে জন্ম নেওয়া রোগী। তাদের বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার ও প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে। চিকিৎসাপ্রাপ্তদের মধ্যে দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক আর বাকিরা শিশু।
জানুয়ারীর শুরুর দিকে অস্ত্রোপচারের জন্য রোগী বাছাই করা হয়। আর ২৩ জানুয়ারি বিদেশি চিকিৎসকরা আসেন। ২৪ জানুয়ারি শুরু হয় অস্ত্রোপচার আর ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। প্রতি অপারেশনে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান আয়োজকরা।
রোটারি ক্লাব অব জালালাবাদের প্রেসিডেন্ট মনজুর আল বাসেত বলেন, "আমরা সপ্তমবারের মতো এই আয়োজন করেছি। রোগীদের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি এটাই আমাদের তৃপ্তি। আশাকরি রোটোপ্লাস্টের মাধ্যমে আগামীতে এরকম আরও আয়োজন করবো।"
সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. ফজলুর রহিম কায়সার বলেন, "এই আয়োজন সফল করতে আমাদের ডাক্তার, ইন্টার্ন, নার্স, স্টাফসহ সকলে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমাদের একাধিক অপারেশন থিয়েটার এই আয়োজনের জন্য বরাদ্দ ছিল। রোটোপ্লাস্ট আগামীতেও এরকম ভালো উদ্যোগ নিলে আমরা তাতে শরিক হতে চাই। আশাকরি তাদের অষ্টম মিশনও আমাদের হাসপাতালে আয়োজন করবেন।"
৩১ জানুয়ারি এই মিশনের সমাপনী আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেভরন বাংলাদেশের পরিচালক (কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) মুহাম্মদ ইমরুল কাবির। তিনি বলেন, "এই আয়োজনে যাদের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, সত্যিকার অর্থেই তাদের জীবন বদলে যাবে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়ার এবং জীবনের সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেবে।"
তিনি আরও বলেন, "শেভরন বাংলাদেশ সামাজিক বিনিয়োগ উদ্যোগের অংশ হিসেবে জীবন পরিবর্তনকারী এই আয়োজনে অংশ নিতে পেরে গর্বিত। আমাদের সামাজিক বিনিয়োগ কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্যই হলো শিক্ষা, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন।"