এনএসআই এজেন্ট সেজে গ্রামের যুবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিল ২ কোটি টাকা!
চট্টগ্রামের এক চা দোকানের মালিক মো. জাফর। এক নারী তাকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলেন, যাতে লেখা ছিল 'মমতাজ বেগম (ওয়ারিশিকা), প্রাইম মিনিস্টার'স অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার'। ছিল জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের লোগোও।
কার্ডটি পেয়ে জাফর ধরেই নিয়েছিলেন- তার হয়ত কপাল খুলে গেছে। কারণ ওই নারী তার ছেলেকে এনএসআইতে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
জাফরের ছেলে সম্প্রতি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। ওই নারী জাফরকে আশ্বস্ত করেন যে তার ছেলেকে তিনি এনএসআইতে ওয়াচার কনস্টেবলের চাকরি নিয়ে দিতে পারেন। এ নিয়ে আলোচনার সময় ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প পেপারে মমতাজ ও জাফর একটি হাওলাতনামায় স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী, মমতাজকে ৬ লাখ টাকা দেবেন জাফর। বিনিময়ে তার ছেলেকে চাকরি দেবেন মমতাজ।
এর পর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও জাফরের ছেলে চাকরি পাননি, জাফর সেই টাকাও ফেরত পাননি।
কেবল জাফরই একমাত্র ভুক্তভোগী নন। প্রায় তিন বছর ধরে একইভাবে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অন্তত ৩০ জনের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মমতাজ।
স্থানীয় ও পরিবারের সদস্যদের তথ্যমতে, মমতাজ বেগমের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের শেখেরহাটে। সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজ থেকে তিনি ডিগ্রি এবং ২০১২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন।
২০০৯ সালে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মুজিবুর রহমান নামে এক সহকারী শিক্ষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
মাস্টার্স পাস করার পর মমতাজ আশা এনজিওতে জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেন। কয়েক বছর পর চাকরি ছেড়ে দেন। ২০২১ সাল থেকে তিনি পরিবারকে জানাতে থাকেন এনএসআইতে চাকরি হয়েছে তার।
কেবল ভুয়া ভিজিটিং কার্ড বের করেই বসে নেই মমতাজ। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে তার দু'জন সোর্সের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা হলেন- সীতাকুণ্ডের পূর্ব সৈয়দপুরের মীর হোসেন ও একই ইউনিয়নের শেখেরহাট এলাকার ফল ব্যবসায়ী মো. জামাল।
মীর হোসেন এক সময় ভাড়ায় গাড়ি চালালেও মমতাজের সঙ্গে পরিচয়ের পর তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক কাম সোর্স হয়ে ওঠেন তিনি।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে এনএসআই-তে সোর্স, ওয়াচার কনস্টেবল, ফিল্ড অফিসারসহ বিভিন্ন পদে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলতেন এই দু'জন। মমতাজ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন।
মমতাজ নিজেকে কখনও প্রধানমন্ত্রীর অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার, আবার কখনও অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর (এডি), এনএসআই নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ও ক্রাইম ইনভেস্টিগেইট উপ-পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিতেন।
মমতাজের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভুয়া চাকরি করছে যুবকরা
মমতাজ ২০২১ সাল থেকে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নিতে শুরু করেন। ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে চাকরি না হওয়ায় সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তার ওপর। অনেকেই তাদের টাকা ফেরত চান। তখন নতুন প্রতারণা শুরু করেন মমতাজ। এনএসআইয়ের লোগো দিয়ে 'এনএসআই সোর্স' নামে খুলে বসেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। এরপর সেখানে সবাইকে যুক্ত করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে থাকেন।
গ্রুপে বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে মমতাজের হওয়া কথাবার্তার স্ক্রিনশট টিবিএসের হাতে এসেছে।
গ্রুপটি খোলার আগে মমতাজ সবাইকে দিয়ে উত্তরা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলান। তিনি সীতাকুণ্ড বাজারের ইসলামী ব্যাংক শাখা থেকে তার টাকার ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে জানিয়ে সবাইকে বাজারে রাউন্ড ডিউটি করতে বলেন। সেইসাথে সন্দেহভাজন যে কাউকে নজরে রেখে প্রয়োজনে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন তিনি। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তাদেরকে ডিউটি বণ্টন করে দেওয়া হয়।
পরে ভুক্তভোগীরা বেতনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মমতাজ তাদের পরবর্তী মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন।
একপর্যায়ে গ্রুপের সদ্যেদের বেতনও দেন তিনি। সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয় ফিল্ড অফিসারদের। কাউকে তিন মাসের, কাউকে কেবল এক মাসের বেতন দেন মমতাজ।
আবার গ্রুপের সদস্যদের কাউকে মমতাজ নিজ বাড়িতেও আমন্ত্রণ জানাতেন। এভাবে সবার কাছ থেকে বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হন।
তার ড্রাইভার মীরও হোসেনও দাবি করেন, তিনি মমতাজের প্রতারণার শিকার।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'চাকরি সরকারি করার কথা বলে আমার কাছ থেকেও টাকা নেন মমতাজ। পরে তিনি আমাকে এনএসআই এর সোর্স হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর আমার ভাতিজা নুর হাদিস, প্রতিবেশী মঞ্জু, মোয়াজ্জিন মামুনসহ অনেককেই লেনদেন করিয়ে দেই সোর্স পদে চাকরির জন্য।'
ফিল্ড অফিসার নিয়োগ পরীক্ষার খাতায় বিশেষ কোড
মো. নুরুজ্জামান খোকন। মাস্টার্স পাস করে বেকার ঘুরছিলেন। এনএসআইয়ে ফিল্ড অফিসার পদে চাকরির জন্য ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন সময়ে মমতাজকে মোট সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিয়েছেন।
খোকনের ভাষ্য মতে শুধু তিনি একা নন, ফিল্ড অফিসার পদে চাকরি জন্য অন্তত সাত যুবক কমবেশি একই পরিমাণ টাকা দিয়েছেন। তারা সবাই ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঢাকায় গিয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষার আগে তাদের বলা হয়েছিল যা পারা যায় তা লিখতে। আর খাতার এক কোণে '৬৬৬১' কোড নম্বর লিখে আসতে। বাকিটুকু তিনি দেখবেন।
খোকন বলেন, 'পরীক্ষার পরে মমতাজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। এখন টাকা ফেরত দিবেন, দিচ্ছেন বলে কালক্ষেপণ করছেন।'
পুলিশকেও পরিচয় দিতেন প্রধানমন্ত্রীর অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার
ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন পরে একজন পাওনাদার মমতাজের বাড়িতে টাকার জন্য চাপ দিলে তিনি নিজেই পুলিশে কল করেন। এরপর সীতাকুণ্ড থানা থেকে একজন এএসআই গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। ওই সময় মমতাজ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার হিসেবে পরিচয় দিলেও কোনো পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সেবার মমতাজ ওসির পায়ে ধরে ক্ষমা চান। পুলিশের মধ্যস্থতায় সেখানেই বিষয়টি মীমাংসা হয়।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার ওসি কামাল উদ্দিন বলেন, ওই নারীর করা এক অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি যার বিরুদ্ধে তিনি (মমতাজ) অভিযোগ করেছেন, তিনিই মমতাজের কাছে টাকা পাবেন। সে সময় টাকা উদ্ধার করে দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়া হয়। পরে অনেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে মৌখিক অভিযোগ দিলেও কেউ মামলা করেনি। তারপরও ওই নারীকে আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।
পুলিশের কাছে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকায় তখন মমতাজ পালিয়ে যান।
এ বিষয়ে মমতাজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা দাবি করেন যে মমতাজ এখন কোথায় আছে সেটি তারাও জানেন না।
জানতে চাইলে মমতাজের স্বামী মজিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমি না পারছি ফাঁসিতে ঝুলতে, না পারছি তাকে তালাক দিতে। কেননা আমার আর্থিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। তবে দ্রুত তাকে তালাক দিয়ে দিব। আমার সব সম্মান শেষ করে দিয়েছে।
মমতাজ কখনও এনএসআইতে কর্মরত ছিলেন কি না জানতে চাইলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মমতাজ কখনোই এনএসআইতে ছিলেন না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মমতাজের কয়েকটি নম্বরে কল করা হলেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে।