বাড়ছে ‘নিরাপদ মাংস’ উৎপাদন, চাহিদাও বেশি বাজারে
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের বহিমান গ্রামের গৃহবধূ পাঁপিয়া গরু পালন করে দিন বদলের উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। বাজারে নিরাপদ মাংস সরবরাহ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন নিজে। স্বচ্ছলতা এনেছেন সংসারে। অবদার রাখছেন জাতীয় অর্থনীতিতেও।
চলতি বছরে তিনি এক গরু বিক্রি করেছেন ৩.৮ লাখ টাকা দামে। এখনো তার খামারে ৩০টির বেশি গরু রয়েছে। আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনের গল্প শোনালেন পাঁপিয়া।
জানালেন, ৭ বছর আগে তার স্বামী শাহীন স্থানীয় বাজারে মুদিখানার ব্যবসা করতেন। বাকির করণে ব্যবসায় লোকসান হয়। এরপর তার বাড়িতে থাকা দুটি ষাঁড় লালন-পালন শুরু করন।
পরে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত আরএমটিপি প্রকল্পের মাধ্যমে গবাদি পশু পালন, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে গাভী পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। বাড়তে থাকে তার আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসেই বর্তমানে পাঁপিয়া কোটিপতি এক সফল উদ্যোক্তা।
জেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জে এবার কোরবানি জন্য ৬.২৫ লাখ গবাদিপশু প্রস্তুত করা হয়েছে— যার বাজারমূল্য প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা। এতে কৃষকের লাভ হবে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা।
সিরাজগঞ্জে জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডানিডার আর্থিক সহায়তায় নিরাপদ মাংস, দুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কাজ বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনডিপি।
এই সংস্থার তথ্য বলছে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে ২৮,০০০ খামারীকে নিরাপদ পদ্ধতিতে মাংস উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব খামারে ১,০২,০০০ গরু নিরাপদ উপায়ে পালন করা হয়েছে।
১২ জেলায় চলছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ
শুধু সিরাজগঞ্জে নয় দেশের বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, ভোলাসহ ১২ জেলায় ২,০১,৪৮০ খামারী ও উদ্যোক্তা নিরাপদ উপায়ে বিদেশি অর্থায়নে পশু লালন পালন কর্মকাণ্ড চলছে।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. নমিতা হালদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, প্রকল্পটি প্রায় তিন লক্ষাধিক প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্ট দরিদ্র মানুষের ব্যবসা প্রসার ও আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় উৎপাদিত নিরাপদ মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিয়েছে। সফল উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য (যেমন-মাংসের আচার ও চিজ) বিদেশে রপ্তানি করে জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখছেন।
কৃষকরা বলছেন, বর্তমানে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি কারিগরি, প্রযুক্তি ও বিপণনের সহায়তা পাচ্ছেন। আধুনিক পশু চিকিৎসার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে নিরাপদ উপায়ে মাংস উৎপাদন সহজ হচ্ছে।
এই প্রকল্পের আওতায় ১,৫৭৭ জন লাইভ স্টক সার্ভিস প্রোভাইডার দেশে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৪৬ জন খামারিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। নিরাপদ উপায়ে গরু পালনের সাথে তারা গোবরও জৈব সার উৎপাদনে কাজে লাগাচ্ছে। সিরাজগঞ্জ তার মধ্যে অন্যতম একটি জেলা।
সিরাজগঞ্জের প্রশিক্ষণ পাওয়া পাঁপিয়ার মতো আরেক নারী উদ্যোক্ত হলেন সদর উপজেলার শিলন্দা এলাকার সীমা খাতুন। তার উন্নত জাতের তিনটি ষাঁড় রয়েছে।
সীমা জানান, "আগে গরু পালনের সময় দেখেছি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতো। কিন্তু আমরা সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণের পর শিখেছি কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গরু লালন-পালন করতে হয়। এখন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কেনো ওষুধ, কৃমিনাশক, দানাদার খাবার, সইলেজ, ঘাস কিংবা পানি খাওয়াই না। এ কারণে এখন গরু খুবই কম অসুস্থ হয়। ফলে বিক্রির সময় আমাদের গরুর চাহিদাও বেশি।"
আরএটিপি প্রকল্প এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশু পালনের জন্য ২০৭টি ভ্যাকসিন হাব উন্নয়ন করা হয়েছে। এখানে উদ্যোক্তারা গরুকে ভ্যাকসিন দেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে ভেটেরিনারি টেলিমেডিসিন সেন্টারও। ভেটেরিনারি ডাক্তারের নিকট থেকে খামারি পর্যায়ে টেলিমেডিসিন সার্ভিস কার্যক্রম অব্যাহত আছে দেশের ১২ জেলায়।
সিরাজগঞ্জ সদরের সয়দাবাদ ইউনিয়নের টেলিমেডিসিন দিয়ে পশু চিকিৎসক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন মো. রহিজ উদ্দিন। তিনি ২০১৯ সালে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এখন ইউনিয়নের প্রায় ১০,০০০ গরুর চিকিৎসা তিনি দেন
রইজ জানান, "কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় এনজির কাছে প্রশিক্ষণের পর এখন আমি গ্রামে পশু চিকিৎসক হিসেবে সেবা দিচ্ছি। গত পাঁচ বছরে সয়দাবাদে চাষীদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গরু মোটাতাজা করণের জন্য এখন আর ওষুধ খাওয়াতে হয় না, খামারীরা বুঝতে পেরেছেন। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাদের নিয়মিত বুঝানো হয়েছে। এই কারণে চাষীরা এখন গরুকে ঘাস ও সাইলেজ খাওয়ান বেশি।"
রইজ উদ্দিন বলেন, "আগে এলাকায় গরুর মরক লাগতো। এখন সেবা আধুনিক হয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমে টেলিকমিউনিকেশন সেবা নেন খামারীরা। মানুষের সময়ও বাঁচে।"
সম্প্রতি রইজের সাথে কথা বলতেই তার কাছে গরু পালনে পরামর্শ নিতে আসেন একই ইউনিয়নের দুখিয়াবাড়ী গ্রামের চাষী আব্দুর শুকর।
তিনি জানান, ঈদকে সামনে রেখে ১২টি গরু মোটাতাজাকরণ করেছেন। আগে গরু মোটাতাজা করণের জন্য তিনি গরুকে স্টেরোয়েড খাওয়াতেন। বাজারে যে যা ওষুধ দিতেন খাওয়াতেন। এতে গরু অসুস্থও হতো বেশি। এখন তিনি দানাদার খাদ্য, সাইলেজ ও কাঁচা ঘাষ খাওয়ান গরুকে।
নিরাপদ গরুর মাংস বিক্রয় কেন্দ্র
কয়েক বছর ধরে গরু পালন করেন সিরাজগঞ্জ সদরের শিয়ালকোর্টের এলাকায় উদ্যোক্তা রাশেদুল ইসলাম। বর্তমানে তার খামারে ২০টি ষাঁড় রয়েছে।
এই উদ্যোক্তা বলেন, "সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে গরু পালনের ফলে এখন বিক্রি করা জন্য হাটে ওঠাতে হয়। ভালো পদ্ধতিতে গরু পালনের কারণে বাড়ি থেকেই বিক্রি হয়। এখন আদর্শ মাংসের দোকান মামা-ভাগ্নের লোজকন মাংস কিনে নেন।"
শিয়ালকোল এলাকার মামা ভাগ্নে অ্যাগ্রো 'নিরাপদ মাংস' বিক্রির প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে আইএসও সদন পেয়েছে। পরিচিতি পেয়েছে জেলাজুড়ে। জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাও এখান থেকে নিয়মিত মাংস কেনেন। বিক্রি হয় বাজারদরেই।
এখানে গরু জবাই করার জন্য আলাদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা রয়েছে। হালাল উপায়ে জবাই শেষে মাটির নিচে পুতে ফেলা হয় গরুর রক্ত ও বর্জ্য।
গত ফেব্রুয়ারিতে চালু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসে গড়ে ৪৫টি গরুর মাংস বিক্রি হয় বলে জানান মাম-ভাগ্নের মালিক আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, "দিন দিন আমাদের এখানে মাংসের চাহিদা বাড়ছে। বাজারের গরু কোথায় বিক্রি হয়, কীভাবে বিক্রি হয় আমরা জানতাম না। ওগুলোই কিনে খেয়েছি। এখন গরু কিনে এনে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এরপর চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তারপর আমরা মাংস বিক্রি করি।"
শুধু স্থানীয়ভাবেই নয় দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানেও যাচ্ছে নিরাপদ উপায়ে লালন-পালন হওয়া এসব গরুর মাংস। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এনডিপি) নির্বাহী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন খান বলেন, "নিরাপদ প্রক্রিয়ায় পালনের কারণে বেঙ্গল মিটের মধ্যেই ২,৩৮২টি গরু কিনেছে। স্বপ্নের আউটলেটে যাচ্ছে মাংস। বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা, বাজার তৈরি, প্রশিক্ষণসহ সফল উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি। আর গরু পালনের সাথে পরোক্ষোভাবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।"
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. ওমর ফারুক বলেন, "শিয়ালকোলে আধুনিক পদ্ধতিতে মাংস বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন হয়েছে। আমি নিজেও সেটি পরিদর্শন করেছি। সেখানে পশু জবাইয়ের আগে তাদের নিজস্ব কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা রয়েছে। জবাই করার আগে একজন চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন গরুতে রোগবালাই আছে কিনা। সুস্থ গরু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জবাই করা হয়। এই গরুর মাংসের পুষ্টিমান ঠিক থাকে। সার্বিক বিবেচনায় এটি নিরাপদ মাংস বলা যায়।"
"এই মডেলকে দেখে যেনো আরও যুবক এগিয়ে আসেন, এ বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। খামারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। প্রাণীর রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণে তারাও যথেষ্ট ভূমিক রাখছেন; বিশেষ করে টিকা কার্যক্রমে। নিরাপদ মাংস উৎপাদন বাড়ছে। বাজারে চাহিদাও বেশি। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা," যোগ করেন ডা. মো. ওমর ফারুক।