কাজে আসছে না ঢাকার ফুটওভার ব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি, বাড়ছে পথচারীদের ভোগান্তি
গত ১১ জুন মাথায় বস্তা নিয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর বাস স্ট্যান্ডের ফুটওভার ব্রিজ পারাপার হচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব আব্দুল গনি মিয়া। সিড়ি বেঁয়ে উঠতে চার-পাঁচবার থেমে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। যদিও ফুটওভার ব্রিজটিতে ওঠার জন্য দুইপাশে দুটি চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) স্থাপন করা আছে, কিন্তু সেগুলো বন্ধ।
গনি মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই চলন্ত সিঁড়ি বসানোর পরে মনে হয় আমি দুই দিনও ব্যবহার করতে পারিনি। ২০১৭ সালে নতুন বসানোর পরে প্রথম বছর ঠিকমতো চলেছিল, কিন্তু এরপরে অধিকাংশ সময়ই বন্ধ পাই। এভাবে বোঝা কাঁধে নিয়ে ওঠা সত্যিই কষ্টের। যদি চলন্ত সিঁড়িটা চালু থাকত, তাহলে কিছুটা কষ্ট লাঘব হতো।'
তিনি আরও বলেন, 'সবসময় ফুটওভার ব্রিজটি দিয়ে পারাপার হই না। রাস্তা দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে অধিকাংশ সময় পারাপার হই। এখন রাস্তায় গাড়ির চাপ বেশি থাকায় ঝুঁকি নিইনি। দেখেন কত মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে গাড়ি থামিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে।'
একই দিনে দুপুরে বনানী সৈনিক ক্লাবসংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজ পারাপার হচ্ছিল নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সায়মা হক। এ ব্রিজটির দুইপাশেও আছে চলন্ত সিঁড়ি। তবে পশ্চিম পাশের সিঁড়িটি চালু থাকলেও পূর্ব পাশের (বনানীর অংশে) সিঁড়িটি বন্ধ ছিল; সিঁড়ির মুখে ছিল তালাবদ্ধ।
সায়মা হক বলে, 'চলন্ত সিঁড়িগুলো অধিকাংশ সময়ই নষ্ট থাকে। ফলে এক পাশের সিঁড়ি দিয়েই ওঠা-নামা করতে হয়। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়ে এই ব্রিজটি পারাপার হতে দীর্ঘ লাইন লেগে যায়। এটা যেন এক ডিজিটাল বিড়ম্বনা।'
শুধু গনি মিয়া কিংবা সায়মা হকই ভোগান্তি পোহাচ্ছে না। ঢাকার তিনটি ফুটওভার ব্রিজে স্থাপন করা ৬টি চলন্ত সিঁড়িই কাজ না করায় এখন বরং ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর জন্য। চলন্ত সিঁড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের।
২০১৪ সালে রাজধানীর বনানী সৈনিক ক্লাবসংলগ্ন প্রথম স্থাপন করা হয় চলন্ত সিঁড়ির সুবিধাসংবলিত ফুটওভার ব্রিজ। তখন কেইস (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্ট) প্রকল্পের আওতায় এ এস্কেলেটর স্থাপন করে পরবর্তীতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এরপর ২০১৬ সালে এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ডে তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক ব্রিজটি নির্মাণের সঙ্গে এস্কেলেটর স্থাপন করেন। ২০২১ সালে যমুনা ফিউচার পার্কসংলগ্ন রাস্তার ওপরে স্থাপন করা হয় চলন্ত সিঁড়িসহ ফুটওভার ব্রিজ।
২০১৯ সালে এ স্থানে বাসচাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হলে সেখানে 'আবরার আহমেদ ফুটওভার ব্রিজ' তৈরির ঘোষণা দেন ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
তবে এই চলন্ত সিঁড়িগুলো চালুর পর মাত্র কিছুদিন ত্রুটিমুক্ত সেবা দিয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
ঘন ঘন মেরামত
এয়ারপোর্টের ফুটওভার ব্রিজের দুপাশেরই চলন্ত সিঁড়ি দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরোপুরো বন্ধ আছে। এর কিছু অংশের কাচ, ঢাকনা ভেঙে ময়লার স্তূপ হয়ে রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। আর বনানী ও যমুনা ফিউচার পার্কসংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজগুলোর এস্কেলেটর মাঝে মাঝে চালু হলেও অধিকাংশ সময়ই হয়ে মেরামত করতে দেখা যায় কিংবা বন্ধ থাকে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) নাঈম রায়হান খান টিবিএসকে বলেন, 'এয়ারপোর্ট ও বনানীর এস্কেলেটরগুলো পুরোনো হয়ে যাওয়ায় এবং ধূলা জমার কারণে সমস্যা দেখা যায় মাঝে মাঝে। এয়ারপোর্টের এস্কেলেটর দুটির বেল্টসহ কিছু যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো বিদেশ থেকে আনার প্রক্রিয়া চলমান আছে। আশা করি দ্রুতই মেরামত করে চালু করতে পারব।'
বনানী ও যমুনা ফিউচার পার্কসংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজ দুটির চলন্ত সিঁড়ি অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এস্কেলেটরগুলোতে সমস্যা দেখা দিলেই আমরা মেরামত করে ফেলি। আমি যতদূর জানি, এখন দুটি ফুটওভার ব্রিজের এস্কেলেটরই চালু আছে। যদি নষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে দ্রুত ঠিক করা হবে। বনানীর এস্কেলেটর দুটি দুপুর ১টা থেকে ২টা ৩০ পর্যন্ত এবং রাত ১০টার পরে বন্ধ রাখা হয়।'
যমুনা ফিউচার পার্কের ফুটওভার ব্রিজটি নিয়মিত ব্যবহার করেন আরশাদুল ইসলাম। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'এ ব্রিজের এস্কেলেটর দুটি অধিকাংশ সময়ই নষ্ট হয়ে বন্ধ থাকে। ফলে বাড়তি সমস্যা পোহাতে হয়। বন্ধ থাকা অবস্থায় এস্কেলেটরের সিঁড়ি দিয়ে একসঙ্গে দুইজন ওঠা-নামা করা সম্ভব হয় না। আবার অনেক সময় এস্কেলেটরের মুখের গেট তালাবদ্ধ থাকে এবং ওঠা-নামার একটি সিঁড়িতে মানুষের দীর্ঘ জট লেগে যায়।'
বিমানবন্দর বাস স্টপেজের সিগন্যালে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা ইউনাইটেড গ্রুপের সিভিল ট্রাফিক তানভীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'এই রাস্তাটি পারাপার হতে সারা দিন-রাতই মানুষের ভিড় লেগে থাকে। যদি এস্কেলেটর সচল থাকত, তাহলে অনেকেই সেটি ব্যবহার করত এবং রাস্তার মধ্য দিয়ে পারাপার কম হতো। তাই মানুষ ভারী বস্তা, ব্যাগ নিয়ে ওপরে উঠতে চান না। ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি রাস্তা পারাপার হন। এর কারণে প্রতিনিয়তই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি ৭ মাসের বেশি সময় ধরে এখানে ডিউটি পালন করি, এর মধ্যে একদিনও চলন্ত সিঁড়িগুলো চালু দেখিনি।'
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানার্স-এর (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা মুখে "স্মার্ট" বললেও স্মার্ট সেবা দেওয়ার মতো মনমানসিকতা আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নেই। আমরা শুধু অর্থ ব্যয়েই অভ্যাস্ত; আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এজন্যই আমাদের এস্কেলেটরের ব্যবস্থাপনা নগরবাসীর জন্য ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে। এখন আবার এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের নামে লাখ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে যা আদৌ কোনো সুফল দিচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু সিটি কর্পোরেশন পাইলটিংয়ে দেখল যে ফুটওভার ব্রিজের এমন এস্কেলেটর রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়, সেহেতু এখন নগরবাসীর জন্য সহজ হয় এমন ব্যবস্থা করা দরকার। সেটা হতে পারে এর চেয়ে একটু নিচু ফুটওভার ব্রিজ এবং ব্রিজে ওঠার সিঁড়ি এমনভাবে তৈরি করা, যাতে মানুষ সহজে উঠতে পারে। সাথে সাথে সিগন্যালগুলোতে অবশ্যই পথচারীদের পারাপারের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে ফুটপাতের সাথে সামঞ্জস্য আনার ব্যবস্থা করা।'