বগুড়ায় কারাগারে ছাদ ফুটো করে আসামিরা পালানোর সময় 'আড্ডা দিচ্ছিলেন কারারক্ষী, ছিলেন না জমাদারও'
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/06/28/bogura_jail_break.jpg)
বগুড়ায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ছাদ ফুটো করে পালনোর ঘটনায় দায়িত্বরত কারারক্ষী ও জমাদারের দায়িত্বে অবহেলার তথ্য সামনে এসেছে। মনাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডেপুটি জেলার এই তথ্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন।
এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও কারা কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কারাগার এলাকা এবং এর অবস্থানগত কারনে নিরাপত্তাজনিত ত্রুটি চার বন্দিকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। তবে ঘটনাটি তদন্তাধীন থাকায় এই বিষয়ে বিস্তারিত আর তথ্য জানাননি ঐ ডেপুটি জেলার।
মূলত আসামিরা পালানোর সময় কারারক্ষী হিসেবে কনডেম সেলের দায়িত্বে ছিলেন আরিফুল ইসলাম। ডেপুটি জেলার জানান, ঘটনার সময় দায়িত্ব পালন না করে অন্য একজন করারক্ষীর (কনডেম সেলের পাশে) সাথে গল্প করছিলেন।
এমনকি তাকে তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রধান কারারক্ষী (জমাদার) হাবিলদার দুলাল মিয়াও ছিলেন অন্য কোথাও। ফলে এই সুযোগে আসামিরা নির্বিঘ্নে পালাতে পেরেছিলেন।
পালানোর পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃতরা আসামিরা হচ্ছেন কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার দিয়াডাঙ্গা গ্রামের নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু (৬০), নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ফজরকান্দি গ্রামের আমির হামজা ওরফে আমির হোসেন (৪১), বগুড়া কাহালু উপজেলার উলট্ট গ্রামের জাকারিয়া (৩৪) এবং বগুড়া সদরের কুটিরবাড়ি গ্রামের ফরিদ শেখ (৩০)। তারা প্রত্যেকেই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
পুলিশ জানায়, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামী গত বুধবার রাত ৩টা পাঁচ মিনিটে পালিয়ে যান। আসামীরা পালানোর কিছুক্ষণ পরেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এই বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গত বুধবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, "আসামিরা বিছানার চাদর ব্যবহার করে দেওয়াল টপকিয়ে বাইরে বের হয়। ভোর রাত ৩টা ৫৬ মিনিটে পুলিশের একাধিক টিম সংবাদ পেয়ে শহরে তল্লালি শুরু করে। এক্ষেত্রে ভোর রাত ৪টা ১০ মিনিটে শহরের চেলোপাড়া চাষী বাজার থেকে চারজনকেই গ্রেপ্তার করে।"
বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল জলেশ্বরীতলা ও মালতীনগর এলাকার করতোয়া নদীর পাড়ে ১৮৮৩ সালে জেলা কারাগার নির্মিত হয়। এই কারাগারের বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৭২০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬৮৩ ও মহিলা ৩৭ জন। তবে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন ১৭০০ জনেরও বেশি।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/06/28/screenshot_2024-06-28_105808.png)
পুলিশ সুপার জানান, আসামিরা কনডেম সেলের পূর্ব দিকে করতোয়া নদী পার হয়ে পালিয়েছিল। ঐ এলাকাটি অনেকটা নির্জন।
এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক জেলার কারা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, "কারাগারে সাধারণত প্রতি সপ্তাহে এক-দুইবার কক্ষ তল্লাশি করা হয়। সেই সময় দেখা হয় আসামীদের কাছে বা কক্ষে কোনো অস্ত্র, মাদক, ধাতব কোনো বস্তু আছে কি-না। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বগুড়ায় এসব কিছু করা হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "এমনটা করা হলে তো কনডেম সেলে আসামিদের কাছে পাওয়া স্ক্রু ড্রাইভার ও স্টিলের পাত উদ্ধার হতো না। তল্লাশির সময় কারারক্ষী, জমাদার ও সুবেদারের থাকার কথা। ক্ষেত্রবিশেষে ডেপুটি জেলারও থাকে। কিন্তু বগুড়া কারাগারে তল্লাশির ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে ব্যত্যয় হয়েছে কি-না কিংবা দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে কি-না দেখা দরকার।"
এদিকে বগুড়া জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সাইফুল ইসলাম জানান, কনডেম সেলসহ কারাগারের উত্তর পাশে নিরাপত্তা চৌকির অভাব রয়েছে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, "বগুড়া কারাগার অনেক পুরাতন। এটি ব্রিটিশ আমলে তৈরি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে ভবনের অনেক স্থান নাজুক। ওই চার আসামিকে এ বছরের ১ জুন এখানে নিয়ে আসা হয়। তাদের রাখাও ছিল একই সেলে।"
ডিসি আরও বলেন, "আসামিরা ছাদের যে অংশে ফুটো করেছে সেখানে ছাদে কোনো রড ছিল না। তারা ছাদে গামছা পেচিয়ে ফুটো করে। আমরা এসব স্থান সংস্কারের কথা বলেছি। এছাড়া আসামিরা যেদিক দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে সেখানে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।"
এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তুহিনুল ইসলাম বলেন, "কারাগারের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে ফাঁসির আসামী পালিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক বিষয়। এখানে কারাগারের কেউ না কেউ জড়িত। সেই সাথে বগুড়ার শহরের মধ্যে থেকে এই স্থাপনা অন্যত্র স্থানান্তর করা দরকার।"
কারাগারের ৮ কর্মকর্তা বরখাস্ত, দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন
এই ঘটনার জেরে কারাগারের ডেপুটি জেলার হাসানুজ্জামান ও প্রধান কারারক্ষী ফরিদ উদ্দিনকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) সাময়িক বরখাস্ত করা করা হয়েছে। এছাড়াও গত বুধবার বরখাস্ত করা হয় তিন কারারক্ষীকে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়েছে।
জেল থেকে আসামি পালানোর ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিএম ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষের দিক থেকেও অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে পালানোর চেষ্টা করা ফাঁসির আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুজন মিয়া বলেন, "চার আসামিকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের আট দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। তবে এর শুনানি এখনো হয়নি।