অবকাঠামো খাতে ঋণের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহী জাপান
বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন— মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ, নতুন বিমানবন্দর নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে আরও ঋণ দেওয়ার পাশপাশি এদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্মেলনে কক্ষে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-জাপান অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্স (ওডিএ) পলিসি ডায়লগ সভায় এই আগ্রহ জানায় জাপানের প্রতিনিধি দল।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, সভায় জাপানের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে– তাদের দেশে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। এই প্রয়োজন মেটাতে জাপানের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণে বাংলাদেশে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোও (বিএমইটি) জাপানের আগ্রহের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। জাপানের জন্য দুটি নিবেদিত (ডেডিকেটেড) প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দিয়েছে বিএমইটি। এই কেন্দ্রগুলোতে জাপানি ভাষাছাড়াও জাপান তাদের দেশের চাহিদা ও কারিকুলাম অনুযায়ী প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে।
পসিলি ডায়লগ সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী। অন্যদিকে, ২০ সদস্যের জাপানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সহকারী মন্ত্রী কুসাকাবে হিদেকি।
নিয়োগ পরিসংখ্যান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
জাপানের বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি ও শ্রমিক সংকটের কারণে দেশটি বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সংশ্লিষ্টরা জাপানের শ্রমবাজারের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গুরুত্বারোপ করেছেন। এতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়তে বলে তাদের অভিমত।
জনসংখ্যাগত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাপান সরকার তার প্রয়োজন অনুযায়ী 'নির্দিষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের' ভিসা প্রোগ্রাম প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত এপ্রিলে এশিয়া নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সম্প্রসারণে চারটি নতুন খাত যুক্ত হবে এবং এর মাধ্যমে ২০২৮ অর্থবছরের মধ্যে জাপানে প্রায় ৮,২০,০০০ প্রবাসী কর্মীর কর্মসংস্থানের অনুমতি দেওয়া হবে।
বিএমইটি প্রতিবেদন বলছে, জাপান গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৯০০ এর বেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।
এদিকে জাপানের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনবল নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। ৯ জুন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে জাপানের বিভিন্ন কোম্পানির ১১ জন প্রতিনিধি দল এ প্রস্তাব দেয়। ইআরডি ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
মেট্রোরেল, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, জাপান মেট্রোরেল এমআরটি-৬ লাইন সম্প্রসারণে ঋণ দেওয়ার প্রাথমিক সম্মতি জানিয়েছে।
এছাড়া গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ জেলায় মেট্রোরেল সম্প্রসারণেও জাপানকে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতেও নমনীয় ঋণ দিতে পারে জাপান। একইসঙ্গে, বাংলাদেশে নতুন বিমানবন্দর স্থাপনেও ঋণ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি।
জাপানের অর্থায়নের এমআরটি লাইন-৬ (মতিঝিল থেকে কমলাপুর) অংশ ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে। মতিঝিল থেকে কমালাপুরে সম্প্রসারণের কাজ আগামী জুনে শেষ হবে। ঢাকা শহরের যানজট দূর করতে এবার এমআরটি-৬ লাইনটি টঙ্গী পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, এমআরটি লাইন টঙ্গী পর্যন্ত সম্প্রসারণের জন্য ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। সমীক্ষার পর দিয়াবাড়ি থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সম্প্রসারিত অংশে কত টাকা ব্যয় হবে, তা জানা যাবে।
এদিকে, ঢাকার শহরের সঙ্গে আশেপাশের জেলার যোগাযোগ সহজ করতে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদী জেলাও মেট্রোরেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএমটিসিএল। ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-২ মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ শহর মেট্রোরেলের নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
এছাড়া এমআরটি লাইন-৬ এবং এমআরটি লাইন-১ মাধ্যমে যুক্ত হবে গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলা। এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের মাধ্যমে নরসিংদী ও মানিকগঞ্জ জেলা যুক্ত হবে। এমআরটি লাইন-৫ সাউর্দান ও এমআরটি লাইন-৪ সম্প্রসারিত হবে নারায়ণগঞ্জ থেকে ভুলতা ও কাঁচপুর পর্যন্ত।
২০৪১ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে।
সুদের হার কমানোর প্রস্তাবে জাপানের 'না'
গত অক্টোবর থেকে জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনালকো-অপরেশন এজেন্সি) ঋণের সুদহার আবারও বেড়েছে। এখন ১.৭ শতাংশ সুদ নিতে হচ্ছে জাপানের এই সংস্থা।
যদিও ২০২২ জাপানি অর্থবছরের (এপ্রিল-মার্চ) প্রথম দিকে জাইকার ঋণের সুদহার ছিল ০.৭০ শতাংশ, পরে শেষের দিকে তা বাড়িয়ে ১.২ শতাংশ করা হয়।
ইআরডির সূত্রে জানা যায়, পিলিসি ডায়লগ সভায় বাংলাদেশের জন্য সুদহার কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে জাপানের প্রতিনিধি দল জানায়, জাপান অঞ্চল-ভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ করে। ফলে একক কোনো দেশের জন্য সুদহার কমানোর সুযোগ নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে সদস্য বিদায়ী অর্থ বছর পর্যন্ত ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের মোট ২৮.৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। জাপানের ঋণে শাহজালার আন্তজার্তিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, যমুনা রেল সেতু, চট্টগাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়নসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।