১৮০ দিনে নিষ্পত্তি হওয়ার চোরাচালানের মামলা বিচারাধীন ১৮ বছর ধরে
১৮ বছর ধরে বিচারাধীন এক চোরাচালানের মামলায় সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালত তাকে ডেকেছে বারবার। তবু তিনি হাজির হননি। সবশেষ গত মে মাসে যখন আদালত তাকে হাজির করার জন্য জামিন-অযোগ্য সাক্ষ্য পরোয়ানা জারি করে, উপায়ান্তর না দেখে গত ১৩ জুন আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি। এর আগে গত সাত বছর ধরে তিনি এড়িয়ে গেছেন সাক্ষ্য প্রদান।
এই মানুষটি হচ্ছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান, যার নামের সঙ্গে এখন সবাই পরিচিত।
মাত্র এক মাসেরও কম সময়ে এনবিআরের চাকরি খুইয়েছেন তিনি, তার 'অবৈধ' সব সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, এবং বর্তমানে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর। এর সবকিছুরই শুরু হয় গত মাসে ঈদুল আজহার ঠিক আগে, যখন তার ছেলে ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত '১৫ লাখ টাকার কুখ্যাত সেই ছাগলটি' কিনতে যান।
কৌতুহলের বিষয় হলো, মতিউর যখন এই মামলায় সাক্ষ্য দেন, প্রায় তার কিছুদিনের মধ্যেই তার পতনের সূচনা হয়। ২০০৬ সালের মে মাসে এই মামলাটি করেছিলেন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) এক কর্মকর্তা। ভারত থেকে চোরাইপথে কাপড় আনায় বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ২৫ ধারায় ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।
আইন অনুসারে, ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ ১৮ বছরের বেশি সময় পরেও ঢাকার বিশেষ জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৩ এ মামলাটি অনিষ্পন্ন অবস্থাতেই রয়েছে।
আদালতের সূত্রগুলো জানায়, মতিউরের কারণেই এই মামলার বিচারকাজ পিছিয়ে গেছে। কিন্তু, এই মামলার সাথে তার সম্পর্কের যোগসূত্র কী?
২০০৬ সালে সিআইআইডি'র একটি বিশেষ অভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার পোস্তগোলার কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি ট্রলার থেকে চোরাইপথে আনা কাপড়ের চালান আটক করে এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে। আলোচিত মামলাটি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।
এসময় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি)-র একজন পরিচালকের পদে ছিলেন মতিউর। আর তাই এ মামলায় তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।
মামলার ছয় নম্বর সাক্ষী মতিউরের ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাক্ষ্য প্রদানের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু, তিনি হাজির হননি। এরপর গত ৭ বছরে ৯ বার তাকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আদালত সমন জারি করে। তবুও তিনি উপস্থিত না হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে মামলার বিচারকাজ।
শেষপর্যন্ত চলতি ২০২৪ সালের মে মাসে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য সাক্ষ্য পরোয়ানা জারি (পুলিশের মাধ্যমে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বাধ্য করা) করেছিলেন আদালত।
আলোচিত মামলাটির শুরু থেকে এপর্যন্ত মোট তারিখ পড়েছে মোট ১২৮ বার। এরমধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৯০ বারেরও বেশি তারিখ পড়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার সময় এই মামলায় আদালত পরিবর্তন হয়েছে তিনটি, বিচারক পরিবর্তন হয়েছেন ১০ জন। এরপরও মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি।
আদালত সুত্রে জানা যায়, মামলার আসামিরা প্রায় এক বছর কারাভোগের পর সকলেই জামিন লাভ করে। প্রতি ধার্য তারিখে ৬ আসামির মধ্যে পাঁচ জন নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেন। বাকি একজন পলাতক রয়েছে।
আসামিদের একজন টিবিএসকে বলেন, "আমরা বিচারকাজে এতদিনের দীর্ঘসুত্রিতায় আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।"
মতিউরের আগের পাঁচজন সাক্ষীও বিচারকাজে বিলম্ব ঘটান, প্রত্যেককে হাজির করার জন্য আদালতকে একাধিকবার সমন জারি করতে হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, শেষপর্যন্ত মতিউরসহ শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের আরেকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মামলার পরবর্তী ধাপে, আগামী ৩১ জুলাই বিচারের শেষ পর্যায়ের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য রয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের দিন কী ঘটেছিল?
২০০৬ সালের ৫ মে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের একটি বিশেষ আভিযানিক দল রাজধানীর পোস্তগোলা ১নং বুড়িগঙ্গা সেতুর শ্মশানঘাট এলাকায় ভোর ৪টার আগে একটি অভিযান পরিচলনা করে। অভিযানের সময় একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার আটকান তাঁরা। ট্রলারটি তল্লাশি করে তরমুজের নিচে লুকানো অবস্থায় চটের বস্তার মধ্যে ভারতীয় শাড়ি ও থ্রিপিস উদ্ধার করা হয়, যার তৎকালীন বাজারমূল্য ৪ কোটি ১২ লাখ টাকা।
এসময় ট্রলারে থাকা ৬ জনকে আটক করে অভিযানিক দল। আরেকজন ট্রলারটি আটকানোর আগেই নদীতে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়।
কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন উপরিদর্শক (এসআই) মধুসুদন সরকার ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঢাকার ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।
অভিযোগপত্র দাখিলের পর ওই বছরই মামলাটি ঢাকার বিশেষ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়।
২০০৮ সালে মামলার অভিযোগ গঠনের পর ঢাকার বিশেষ জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে মামলাটি বিচার করার জন্য ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৭ তে বদলি করা হয়। ওই বছরের শেষদিকে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থকলেও – কয়েক জন সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিলের আগে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল, মামলার বাদী শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল মাহমুদ আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ সাক্ষ্য দেন মোট পাঁচজন। এরপর ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল মতিউর রহমানের।
দ্রুত ন্যায়বিচার চান অভিযুক্তরা
মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ১৭ নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ- তৃতীয় আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
আসামিরা হলেন, খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা থানার আব্দুল কাদের; ফরিদপুরের শ্যামনগরের মো. লুৎফর রহমান; খুলনার রুপসা থানার মো. আলম; পটুয়াখালীর আব্দুল মালেক তালুকদার; ভোলার লাল মোহন থানার আব্দুল ওয়াহাব, ও বরিশাল কোতোয়ালী থানার আলাউদ্দিন।
পুলিশের রিমান্ডে তারা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব শাড়ি ও থ্রিপিস ভারত থেকে চোরাইপথে আমদানির কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়।
এই মামলার প্রধান আসামি আব্দুল কাদের নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেন। তার দাবি, অভিযানের সময় তার বয়স ছিল ৪৫ বছর।
টিবিএসের কাছে তিনি আরও দাবি করেন, তিনি এই ঘটনার সাথে জড়িত নন। তাকে অন্য একটি ট্রলার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আব্দুল কাদের বলেন, অভিযুক্ত কাদের বলেন, "আমার বয়স এখন ৬০ এর বেশি। শরীরও ভালো না। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে আমার জমিজমা সব বিক্রয় করতে হয়েছে। চোখের সমস্যা, ডায়াবেটিসসহ নানান শারীরিরি জটিলতায় ভুগছি। দ্রুত বিচার সম্পন্ন হলে ন্যায়বিচার পেতাম।"
যদিও আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারি জানিয়েছেন, আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে একাধিক চোরাকারবারি ও মাদকের মামলা রয়েছে।
আসামীদের পক্ষের আইনজীবী সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্ধারিত সময়ে সাক্ষীরা আদালতে না আসায় মামলাটি নিষ্পত্তি হচ্ছিল না। অনেক বছর ধরে মামলার অগ্রগতি নিয়ে কেউ আর তেমন খোঁজখবর রাখতো না।
তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটির বিচার সম্পন্ন হলে আসামীরা ন্যায়বিচার পেত। বিলম্বের কারণে আসামীরাও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে।
বাদী ও অন্য কর্মকর্তারা অবসরে
এই মামলার বাদী আব্দুল্লাহিল মাহমুদ বেশ আগেই অবসরে গেছেন। এই মামলার আরো দুই সাক্ষী, এনবিআরের সাবেক কমিশনার মো. শাহ আলম খান ও কাস্টমস কর্মকর্তা মো. নূর উদ্দিন-ও অবসরে গেছেন। এছাড়াও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা- এসআই মধুসুদন সরকারও চাকরি জীবন শেষ করে অবসর নিয়েছেন।
এছাড়া এর বিচারকাজে জড়িত (বর্তমান আদালতের) ৮ জন বিচারক বদলী হয়েছেন। সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য তারিখ পড়েছে ৯০ বারেরও বেশি। প্রত্যেক সাক্ষীকে একাধিকবার আদালতের সমন জারি করে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হাজির করতে হয়েছে।
'বিচার বিলম্বিত হওয়া বাংলাদেশে সাধারণ প্রতিবন্ধকতা'
এই মামলার বিচারে ধীরগতি নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের একটি সাধারণ প্রতিবন্ধকতা। এটিতো ১৮ বছরের পুরোনো মামলা, এমনও মামলা আছে ৫০/৬০ বছর ধরে যার বিচার চলছেই, আর শেষ হচ্ছে না।"
তিনি বলেন, "আমাদের দেশের যে পরিমাণ জনসংখ্যা– তার আনুপাতিক হারে আদালতের পরিমাণ অনেক কম। ফলে আদালতের একেকজন বিচারকের ওপর মাত্রারিক্ত মামলার চাপ। ফলে একটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চাইলেও– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি সম্ভব না।"
সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, এই মামলার আসামীরা সবাই 'স্পট এরেস্টেড' (ঘটনাস্থলেই গ্রেপ্তার) । জব্দ করা মালামাল অন্যতম প্রমাণ। ফলে সাক্ষীদের জন্য মামলার বিচার বিলম্ব করা যৌক্তিক নয়। "এখানে হয়তো সরকারি আইনজীবী ও আসামিদের আইনজীবীর কোনো বড় গাফিলতি রয়েছে, এছাড়া এই মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। সংশ্লিষ্ট বিচারককেও আরো আন্তরিক হতে হবে" - যোগ করেন তিনি।
মামলাটি কত দ্রুত নিষ্পত্তির কথা ছিল?
কালোবাজারি ও মজুদারির অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ২৫ ধারায় এ মামলা দায়ের করা হয়। এই ধারা অনুযায়ী, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে– অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা সর্বনিম্ন ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়াও অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে।
একইসাথে মামলাটিতে ১৯৬৯ সালের শুল্ক আইন, ১৯৫৩ সালের আমদানি রপ্তানি আইন, এবং ১৯৪৭ সালের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের কয়েকটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের এরকম মামলা নিষ্পত্তিতে ফৌজদারী কার্যবিধি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ, ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে এই মামলা নিষ্পত্তিতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তিনি বলেন, "দেশে ১৮০ দিনে কোনো ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির হওয়ার– কোনো নজির আমার জানা নেই।" তবে শুধু বিচারবিভাগের ওপর মামলার বিচার বিলম্বের দায় চাপালে হবে না। যদিও এই মামলায় বিচারকাজ শুরু করতেই প্রায় দুইবছর বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু সাক্ষীরা এত বেশি অবহেলা করেছে, যা মামলায় বিলম্বের মূল কারণ।
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হাজার হাজার মামলা
ঢাকা জেলার জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ ২১টি আদালতকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এসব আদালতে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ– বিভিন্ন বিশেষ আইনের মামলার বিচার হয়।
এপর্যন্ত এসব আদালতে প্রায় ৫ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪-সহ আরো বিভিন্ন বিশেষ আইনের ৪৪ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই ৪৪ হাজার মামলার মধ্যে দশ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার মামলা।
সসারাদেশে এখন প্রায় ৪৯ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে। এসব মামলার মধ্যে প্রায় ২৯ লাখ ফৌজদারী আইনের মামলা। ফৌজদারি আইনের মামলাগুলোর মধ্যে ১০ বছরের বেশি পুরাতন মামলা রয়েছে প্রায় ৭ লাখ।