'বাবার শেষ সম্বলটুকুও আর রইল না'; সাঈদের মৃত্যুতে পরিবারে শোকের মাতম
'বাবা-মায়ের বয়স শেষ সম্বল ছিল আবু সাঈদ। পড়াশোনা করে সংসারের কষ্ট লাঘব করবে। বাবা প্রায় আমাকে বলত, দেখিস সাঈদ বড় চাকরি পাবে। আমাদের সম্মান আরও বাড়বে। কিন্তু বাবার সেই আশা আর পূরণ হলো না। পুলিশের গুলিতে বাবার শেষ সম্বলটুকুও আর রইল না।'
কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের ভাই,আবু হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে ফোনে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন।
গতকাল মঙ্গলবার সারাদেশের মতো রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও (বেরোবি) কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। এসময় মাঠে ছিলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং এই আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ (২২)।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা মদনখালী ইউনিয়ন পরিষদের বাবনপুর নালিপাড়া গ্রামে আবু সাঈদের বাড়ি।
বাবা মকবুল হোসেনের নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তান সাঈদ। ভাই-বোনদের মধ্যেই তিনিই পড়াশোনার সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্যান্য ভাই-বোনেরা পড়াশোনা বেশি না করার কারণে কৃষি কাজ করেন। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান কেউ। কেউ কেউ গার্মেন্টেসে কাজ করেন।
টাঙ্গাইলে গার্মেন্টেসে কাজ করা সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন বলেন, 'বাবার অল্প কৃষি জমি আছে। এই জমি আর ছোট ভাইয়ের আয়ে সংসার চলত। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আমার ছোট ভাইটাই শুধু পড়াশোনা করেছিল। '
গতকাল শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে মিছিল নিয়ে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আসে। মিছিলের সবার সামনে ছিলেন সাঈদ।
ওই সময়ের কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। তখন সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় সাঈদের শরীরে একাধিক বুলেট লাগে। এক পর্যায়ে তিনি সড়কের ওপর বসে পড়েন। তখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসে তাকে নিয়ে যান।
সাঈদ পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছেন। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল ছিল, পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। পরে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন। এবার কলেজের শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছেন তিনি।
সাঈদ তার নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া করে এতদূর পর্যন্ত এসেছিলেন। মেধা ও আচরণে গ্রামের সবারই প্রিয় ছিলেন।
এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রংপুরে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের এবং বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খরচ চালাতেন তিনি। তিনি ও তার পরিবার কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না।
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাঈদের বাবা। 'পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি এর বিচার চাই', কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলতে থাকেন তিনি।
ময়না তদন্তের পর সাঈদের মৃত্যুর কারণ জানা যাবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ইউনুস আলী।
গতকাল রাত দুইটার দিকে আবু সাঈদের লাশ তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে। আজ সকাল ৯ টার দিকে রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামে জাফরপাড়া মাদ্রাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মানুষের ঢল নামে। জানাজায় ইমামতি করেন, আবু সাঈদের আত্মীয় মো. সিয়াম মিয়া। পরে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন আবু সাঈদ।