‘আব্বু আল্লাহর কাছে গেছে, এখন দেখতে আসেনা, কোলে নেয়না’
"আব্বু আল্লাহর কাছে চলে গেছে। এখন আমাকে দেখতে আসেনা, কোলে নেয়না, মোবাইলেও কথা বলেনা," মো. জুয়েলের (৩১) তিন বছরের মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা কথাগুলো বলছিল।
৩১ বছর বয়সী জুয়েল একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। বন্ধুদের সাথে রাজধানীর শনির আখড়ার দনিয়া কলেজের সামনে সম্প্রতি কোটা সংস্কার বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পরিবার জানায়, বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার দিন তার বুকে গুলি লাগে।
ঘটনার দিন দুপুরে জুয়েল পরিবারের ৮ জনের সাথে খাবার খেয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। খাবার টেবিলে রাতের মধ্যে বাবার জন্য ওষুধ নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেন জুয়েল। যদিও সে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি তিনি; রাত ৯টায় অ্যাম্বুলেন্সে জুয়েলের লাশ বাড়িতে পৌঁছে দেন ৪ জন ছাত্র।
বুধবার বিকেলে নিজবাসায় জুয়েলের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার (২২) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রোববার (৪ আগস্ট) বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে জুয়েলের সাথে মুঠোফোনে ৫১ সেকেন্ড কথা হয়। না জানিয়ে শনির আখড়ায় যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে বললো কিছুই হবেনা, বন্ধুরা সাথে আছে। এরপর ৭টা ৪৮ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র ওই ফোন থেকে কল দিয়ে বলে একটা দুঃসংবাদ আছে। আপনাদের জুয়েল মারা গেছে, লাশ নিয়ে যেতে হবে। সে বললো আমরাই পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনাদের ঠিকানা বলেন।"
রাত ৯টার দিকে জুয়েলের মরদেহ বাড়িতে এসে পৌঁছায়।
সুমাইয়া আক্তার বলেন, আমরা এক সপ্তাহ ধরে জুয়েলকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করি। কিন্তু অফিস বন্ধ থাকায় সে বারবার আন্দোলনে যেতে চায়। সেদিন দুপুরে খাবার পর আমার শাশুড়ি তাকে যেতে বাধা দিলে ঝাড়ি দিয়ে উঠে যায় জুয়েল। সেসময় সে আর বের হয়নি। তার ভাইয়ের সাথেই থাকে। কিন্তু বিকেলে সে আমাকে না জানিয়েই বেরিয়ে যায়।"
২০১৯ সালে কুমিল্লার মুরাদনগরের মেয়ে সুমাইয়া আক্তারের সাথে বিয়ে হয় জুয়েলের। ১০ মাস বয়সী ছেলে মো. আব্দুল্লাহ ও তিন বছরের মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা নিয়ে ভালোই চলছিল জুয়েলের পরিবার। তাদের সাথে সম্প্রতি হার্ট সার্জারি করা বাবা, মা, এক ভাই ও সন্তানসহ এক বোন নিয়ে মোট ৯ জন বাঁশেরপুল রোড এলাকার ডগাইর নতুনপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন জুয়েল।
জুয়েলের পিতা গার্মেন্টস শ্রমিক মো. সিরাজুল ইসলাম গত ত্রিশ বছর যাবত ঢাকার ডেমরায় বাঁশেরপুল রোড এলাকায় বসবাস করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার তিতাস থানার জিয়ারকান্দি গ্রাম।
মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, "আমার বড় ছেলে জুয়েল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে পেরেছি। ছোটবেলা থেকেই সে সংসারের হাল ধরে। সে হাতিম কেম্পানি লিমিটেডে টেকনিশিয়ানের কাজ করতো। পাশাপাশি ওভারটাইমে আরেকটি কোম্পানিতে এসি মেরামতের কাজ করতো। সে বসে থাকার ছেলে ছিল না, পরিশ্রম করতো খুব। কষ্ট নিয়েই চলে গেলো ছেলে আমার।"
জুয়েলের মা নিলুফা বেগম বলেন, "শেখ হাসিনা পালানোতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এতো খুনোখুনির পর আমাদের মনে কোনো খুশি নেই। দেশে শান্তি ফিরে আসুক, কোনো মায়ের কোল খালি না হোক। আমরা এই অরাজকতা আর দেখতে চাচ্ছিনা। জুয়েল কোনো দলীয় রাজনীতি পছন্দ করতো না। কিন্তু ছাত্ররা আন্দোলন করলে তাদের খবরাখবর বাড়িতে বলতো যে, ছাত্রদের এটা যৌক্তিক দাবি।"
জুয়েলের ভাই ডেমরা ইউনিভার্সিটি কলেজে অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মাদ আল আমিন বলেন, "এখন আব্বুর হার্টে রিং পরানো হয়েছে। আব্বু গার্মেন্টস এর কাটিং ইনচার্য থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন ভাইয়ের আয়ের ওপর নির্ভর করে আমরা চলতাম। ভাইয়ের ছোট ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে, আব্বুর চিকিৎসা সব মিলিয়ে আমরা দিশেহারা সময় পার করছি।"
জুয়েলের ছোট বোন একটি বেসরকারি হাসপাতালের ফিডব্যাক অফিসার শারমিন সুলতানা বলেন, "সে বের হওয়ার সময় আমি আন্দোলনকারীদের খাবার দিতে যাচ্ছিলাম। ভাইয়াকে রিকশাতে উঠতে বললেও সে কথা শোনেনি।"
"গত কয়েকদিন যাত্রবাড়ি এলাকায় আন্দোলনকারীদের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় অনেকেই খাবার রান্না করে দিতে যায়। আমি ও বড় ভাইও খাবার দিয়ে আসতাম। কিন্তু সেদিন সে আমার সাথে গেলোনা। সে বললো সে শনির আখড়ায় কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিছিলে যাবে," বলেন তিনি।
শারমিন সুলতানা আরও জানান, "আমার ফোনে ৫টা ৪৬ মিনিটে ভাইয়ার ফোন থেকে দুইবার কল আসে, কিন্তু রিসিভ করতে পারিনি। কিছুক্ষণ পরে, ছোটভাই আল আমিন জানালো বড়ভাইয়ের গুলি লেগেছে, হাসপাতালে যেতে হবে।"
"আমরা বাবা-মাকে না জানিয়েই বিশৃঙ্খল রাস্তায় গাড়ি ভাড়া করে ঢামেকে আসি। বিভিন্ন জায়গাতে খুজেঁও জুয়েলের খবর পায়নি। এসময় আল আমিনের বন্ধু জানায় জুয়েলের লাশ ছাত্ররা বাসায় দিয়ে গেছে।"
তিনি বলেন, "পরে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে কয়েকবার যোগাযোগ করেও ডেথ সার্টিফিকেট পায়নি।"
সেদিন বিকেলে শনির আখড়ায় দনিয়া কলেজের সামনে আন্দোলনরত জুয়েলের বুকে গুলি লাগে। কিছুক্ষণ পর সঙ্গীরা রিকশায় করে জুয়েলকে নিয়ে মাতুয়াইল ও যাত্রবাড়ির দুটি হসপিটালে গিয়ে প্রত্যাখাত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সামিউল আলম খান টিবিএসকে বলেন, "চারজন ছেলে রিকশায় করে জুয়েলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসে। জরুরি বিভাগে আনা মাত্রই জুয়েলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। পরে সাধারণ মানুষ তাকে জরুরি বিভাগের ফটকের সামনে নিয়ে আসে।"
"জুয়েলের পকেটে থাকা কাগজ দেখে আমরা তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি। আমরাই ৫ হাজার টাকা তাৎক্ষণিকভাবে তুলে ডেমরায় অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করি," যোগ করেন সামিউল।
পরেরদিন জুয়েলকে ডেমরার সারুলিয়াতে ডগাইর কবরস্থানে দাফন করা হয়।