দায়ী রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিচার, আকস্মিক বন্যার ক্ষতিপূরণ দাবিতে ফেনীতে মানববন্ধন
ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক বন্যায় প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় দায়ী রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে ফেনীতে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় নাগরিক সমাজ।
বুধবার (২৮ আগস্ট) সকালে ফেনী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এলাকায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ।
তারা দায়ী রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ন্যায্য ও সুষ্ঠু বন্টনের দাবি জানান। এই প্রতিবাদের মাধ্যমে তারা বন্যার ভয়াবহতা তুলে ধরার পাশাপাশি এবিষয়ে জরুরিভাবে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানান।
'আমরা ফেনীবাসী' ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে উজানের বিভিন্ন নদীতে থাকা বাঁধ ভেঙে দেওয়া, এ অন্যায় আচরণের জন্য দায়ী সবাইকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা, দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে বন্যা দুর্গত প্রত্যেককে সেই ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতকরণ এবং জলবায়ুর ন্যায্যতা নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), ইউথ ফর ক্লাইমেট জাস্টিজ, প্রয়াস ও মিশন গ্রীণ বাংলাদেশের প্রতিনিধিসহ জেলার সর্বস্তরের মানুষ এই মানববন্ধনে অংশ নেন।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের (বিএনসিএ) আহ্বায়ক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এবারের বন্যার মত এমন ভয়াবহ চিত্র বিগত ১০০ বছরের ফেনী জেলার ইতিহাসে দেখা যায়নি। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, চলমান বন্যায় দেশের ১১ জেলায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধুমাত্র ফেনীর ৬ উপজেলা পানিতে তলিয়ে ৬৪ হাজার ১৬১টি গবাদিপশু ও ২৩ লাখ চার হাজার ৪১০টি হাঁস-মুরগির মৃত্যু হয়েছে। এতে প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৩৯১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এলজিইডির তথ্য মতে, এ বন্যায় প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৫৪২ কিলোমিটার রাস্তা এবং এক হাজার ৬৬টি ব্রিজ-কালভার্ট।
চলমান বন্যাকে 'রাজনৈতিক বন্যা' উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী উজানের দেশ ড্যামের ইমার্জেন্সি গেট খোলা অথবা ড্যাম ভেঙে গেলে সেই তথ্য অবশ্যই ভাটির দেশকে জানিয়ে দেবে, যাতে ভাটির দেশ বন্যার পূর্বাভাস দিতে পারে এবং বন্যার্ত অঞ্চল থেকে লোকজনকে দ্রুত সরিয়ে নিতে পারে, এবার এর ব্যত্যয় হয়েছে, যার দায় ভারতের। একটি গণবিপ্লবের পর যখন একটি নবীন সরকার দেশ পুনর্গঠনে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এই অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা প্রমাণ করে এটি একটি রাজনৈতিক বন্যা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা, অসতর্কতা ও সার্বিক অব্যবস্থাপনাও এই বন্যার জন্য দায়ী।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এখনো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি, এটি কার্যকর করতে হবে। বাংলাদেশে নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হয়ে গেছে, পাশাপাশি নদী গুলোর গভীরতাও কমে গেছে এবং দখল দূষণের ফলে নদীর পাড় সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে ফলে অতিবৃষ্টি বা উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নদী ধারণ করতে পারে না ফলে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়।
পরিবেশ ও জলবায়ু সাংবাদিক কেফায়েত শাকিল বলেন, এবারের বন্যায় দোতলা বিল্ডিংয়েও পানি উঠেছে। এ অঞ্চলের মানুষ মোটামুটি সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু ষড়যন্ত্রের এ বন্যায় সব তছনছ হয়ে তারা সব হারিয়েছেন। প্রত্যেককে আবার নতুন করে সব গুছাতে হবে। ভারত চাইলেই পানি ছেড়ে দিবে, আমাদেরকে ডুবিয়ে দিবে, আর দেশবাসী আমাদের উদ্ধার করবে, ত্রাণ দিয়ে বাঁচাতে আসবে, এটি বারবার হতে পারে না। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের এই অন্যায়ের বিচার চাই। জাতিসংঘের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা চাই।
মানববন্ধন থেকে উজানের বিভিন্ন নদীতে থাকা বাঁধ ভেঙে দেওয়া, এই অন্যায় আচরণের জন্য দায়ী সকলকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা, দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে বন্যা দুর্গত প্রত্যেককে সেই ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করণ এবং জলবায়ুর ন্যায্যতা নিশ্চিতের দাবিও জানান তিনি। বলেন, ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশনে বাংলাদেশ ভোট দিলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে এখনও অনুস্বাক্ষর করেনি। ফলে পানি নিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইনী প্রতিকার পাওয়া কঠিন। অতিসত্বর বাংলাদেশকে অনুস্বাক্ষর করার দাবি জানান।
সাংবাদিক কেফায়েত শাকিল বলেন, এখন আবার প্রতিবেশী দেশ ভারত রাজনৈতিক বন্যা দিয়ে আমাদের ভাসিয়েছে। ভারত চাইলেই পানি ছেড়ে দিবে, আমাদেরকে ডুবিয়ে দিবে, আর দেশবাসী আমাদেরকে উদ্ধার করবে, ত্রাণ দিয়ে বাঁচাতে আসবে, এটি বারবার হতে পারে না। আমার দেশের পানির নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবে অন্যের হাতে থাকতে পারে না। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের এই অন্যায়ের বিচার চাই। জাতিসংঘের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা চাই।
মানববন্ধনে তরুণ সমাজের প্রতিনিধি ইউথ ফর ক্লাইমেট জাস্টিজের ইভেন্ট এন্ড প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর এস জেড অপু বলেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কারণে আমরা এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানান দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছি। তার মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী দেশ আমাদেরকে আরো ইচ্ছাকৃত দুর্যোগে ফেলছে। ফেনীতে যে পানি উঠেছে এটা কখনোই প্রাকৃতিক না। গত একশ বছরেও প্রাকৃতিক বন্যায় এর অর্ধেক পানিও আসেনি। এবারের বন্যা হয়েছে ভারত হঠাৎ করে বাঁধ খুলে দিয়ে পানি ছাড়ার কারণে। আমরা চাই নদী তার মতো চলুক। কোনো নদীতে বাঁধ থাকতে পারবে না। পানিকে কেউ বাধা দিবে না। তাই সব বাঁধ ভেঙে দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ফেনী কমিটির সদস্য নূর হোসেন বলেন, এই বন্যা নিঃসন্দেহে ষড়যন্ত্রের বন্যা। আমাদেরর বাবা দাদাদেরও কেউও এমন বন্যা দেখেনি। এই ষড়যন্ত্রে আমরা আজ নিঃস্ব। তাই স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরালো করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। দোষীদের বিচার নিশ্চিত এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।
মানববন্ধনে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনী রাষ্ট্রগুলোর নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। পানি বৈষম্যের শিকার বন্যার্ত মানুষদের পাশে সরকারসহ দেশবাসী এবং প্রবাসীদের যৌথ ভূমিকা এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং কূটনৈতিকভাবে সরকারকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানানো হয়।