লক্ষ্মীপুরে গ্রামের পর গ্রাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সুপেয় পানির জন্য হাহাকার
লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী আঞ্চলিক সড়ক থেকে মান্দারি বাজার হয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মান্দারি-কুশাখালী সড়ক। এ সড়কের ওপর এখন নৌকা চলে।
সড়কের ওপর কমপক্ষে ৩-৪ ফুট পানি। হেঁটে যাতায়াত করা প্রায় অসম্ভব । দূরদূরান্তের মানুষের পক্ষে যাতায়াত করা খুবই কঠিন। এলাকার বেশির ভাগ মানুষের যাতায়াতের অন্যতম বাহন এখন ট্রাক্টর কিংবা ট্রলি। বুধবার (২৮ আগস্ট) পুরো দিন এবং বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
সদর উপজেলার জামিরতলি এলাকায় কথা হয় জমির সর্দার নামের এক ব্যক্তির সাথে। তিনি জানান, অসুস্থ মানুষের কষ্টের সীমা নেই। হাসপাতাল ও বাজারে যাওয়া যাচ্ছে না, পানি আর পানি।
তিনি বলেন, "গত শনিবার (২৪ আগস্ট) থেকে আমরা পুরোপুরি বন্যায় বন্দি হয়ে আছি। তবে এর আগেই প্রায় ১ মাসের বেশি সময় আমাদের এলাকার খাল বিল সব ডুবে ছিল। পানি নেমে যাওয়ার পথ ছিল না। এখন কত দিনে পানি নামবে জানি না।"
দিঘলী-মান্দারি সড়কের পাশে কমর উদ্দিন মিঝি বাড়িতে ৪২ পরিবারের বসতি। এখন আছে ১০ পরিবার। বাকিরা আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা আত্মীয়দের বাসায় উঠেছে। পুরুষেরা দিনের বেলায় বাড়িতে আসে, রাতে ফিরে যায়। বাড়িতে একমাত্র নারী বাসিন্দা কহিনুর বেগম জানান, "চুরির ভয়ে বাড়ি ছেড়ে যাইনি। এখন রান্নার অভাবে একবেলা খাই, অন্য বেলা খেতে পারি না। আমাদের অভাব নেই; কিন্তু রান্না করার মতো শুকনো জায়গা নেই। সবখানে পানি।"
সড়ক থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতার পানিতে তলিয়ে গেছে সড়ক। এলাকা জুড়ে নৌকা না থাকায় কিছু কিছু মানুষ কলা গাছের ভেলা বানিয়ে সামান্য দূরে যাতায়াত করছেন।
বুধবার (২৮ আগস্ট) বিকেলে পানির মধ্য দিয়েই প্রায় ১০ কিলোমিটার গিয়ে দেখা গেছে, সড়ক ধরে বহু মানুষ পানির বোতল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। কালু মিয়া ও রহমান মিয়া নামের দুই ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তারা জানান, গ্রামের পর গ্রাম সব বাড়িতেই নলকূপ ডুবে গেছে। পান করার মতো পুরো এলাকায় কোন পানি নেই। এখন ত্রাণ হিসেবে দেওয়া পানিই তাদের একমাত্র ভরসা।
কালু মিয়া জানান, তার ৮ জনের পরিবারের জন্য দিনে ৫লিটার পানি ত্রাণ হিসেবে চার বার পেয়েছেন। রহমান জানান, পানি না কমলে আগামী অনেক দিন বোতলের পানিতে চলতে হবে পুরো গ্রামবাসীকে। কিন্তু সবার পক্ষে পানি কেনাও সম্ভব নয়।
মনোয়ারা নামের এক নারী জানান, পুরো একদিন তিনি এক গ্লাস পানি পান করতে পারেননি। পরে রাতে তার স্বামী দূরের এক বাড়ির টেপ থেকে এক কলসি পানি এনেছেন।
মান্দারি এলাকার বাসিন্দা সেলিম মিয়া (৬০), চন্দ্রগঞ্জের বাসিন্দা রিয়েল মিঝি (৫৫) এবং চরশাহী গ্রামের বাসিন্দা মো. মাউন ( ৪০) জানান, গত ২০ আগস্ট ভারত থেকে আসা পানির প্রবাহের কারণে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা বন্যায় প্লাবিত হয়। কিন্তু লক্ষ্মীপুর জেলায় এর কোনো প্রভাব ছিল না। তবে তার অনেক পূর্বেই ভারী বৃষ্টির কারণে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা ছিল।
স্থানীয় এ বাসিন্দারা জানান, গত শনিবার (২৪ আগস্ট) ভারী বৃষ্টির সাথে নোয়াখালী থেকে ঢলের মতো পানি দ্রুত নেমে আসতে থাকে লক্ষ্মীপুরে। এতে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় জেলা জুড়ে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকে। সোমবার (২৬ আগস্ট) লক্ষ্মীপুর জেলা জুড়ে বন্যার ভয়াবহতা দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য হন। বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) পর্যন্ত পূর্ব থেকে পশ্চিমে রাস্তা দিয়ে পানি যেতে থাকে।
তবে বর্তমানে পানির উচ্চতা প্রায় ৬ ইঞ্চির মতো কমে এসেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, ২৪ আগস্টের পর থেকে লক্ষ্মীপুরের ৫৮টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার মধ্যে ৪৫টি ইউনিয়ন এবং ৩টি পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৯০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অন্যদিকে জেলার চর কাদিরা ও চরপোড়াগাছা ইউনিয়নে ৪০ দিনের মতো ব্যাপক জলাবদ্ধতা থাকার পর সেটি এখন ভয়াবহ বন্যার রূপ নিয়েছে।
লক্ষ্মীপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অফিসের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করা হবে। তবে এখনো বন্যা থাকায় হিসেবে করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহম্মদ কবির জানান, "সুপেয় পানির জন্য লক্ষ্মীপুর স্বাস্থ্য বিভাগ, লক্ষ্মীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও রেডক্রিসেন্ট একত্রে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ টেবলেট দিচ্ছি। রেডক্রিসেন্ট সুপেয় পানি দিচ্ছে।"
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান জানিয়েছেন, বুধবার থেকে বৃষ্টিপাত না থাকায় লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থানে চার থেকে ছয় ইঞ্চি পানি কমে গেছে। তবে জেলাজুড়ে এখনো বন্যার যে পানি রয়েছে, তা কমতে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, ১৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাদুর্গতদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ১৫৫ টন চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।