লক্ষ্মীপুরে ধীরগতিতে কমছে পানি, ফেনীর ছয় উপজেলায় কৃষি-প্রাণিসম্পদের ক্ষতি ৯১৪ কোটি টাকা
বৃষ্টি না হওয়ায় গত বুধবার থেকেই লক্ষ্মীপুরের বন্যাদুর্গত এলাকায় ধীর গতিতে পানি কমতে শুরু আজ শুক্রবার পর্যন্ত তিন দিনে এক থেকে দুই ফুট পর্যন্ত পানি কমেছে। উল্লেখজনকভাবে পানি না কমায় এখনও বহু ঘরবাড়িতেই হাঁটুসমান পানি।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা থেকে লক্ষ্মীপুরে প্রবেশের প্রধান পথ লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী সড়ক। এ সড়কের চৌমুহনী থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার অংশ এখনো পানির নিচে। ফলে লক্ষ্মীপুরের সাথে অন্যান্য জেলার দ্রুত যোগাযোগ কার্যত স্থবির বলা চলে।
চন্দ্রগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সোহেল মাহমুদ মিলন বলেন, লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী সড়ক দিয়ে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট ফেরীঘাট হয়ে ২২ জেলার যানবাহন যাতায়াত করে। কিন্ত গত কয়েক দিন তেমন যানবাহন চলছে না। মালবাহী গাড়িগুলো খুবই ঝুঁকি নিয়ে চলছে। রাস্তায় পানির মধ্যে বড় বড় গর্ত হয়েছে। বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে রাস্তার প্রতি মিটারেই।
চন্দ্রগঞ্জ বাজারের আশপাশের সবগুলো গ্রাম এখনো পানিতে ডুবে রয়েছে। নৌকা ছাড়া কোনো বাড়িতে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। বাজারে লোক সমাগম কমে গেছে।
রামগঞ্জ উপজেলার করপাড়ার ইউনিয়নের গাজীপুর বাজারের ব্যবসায়ী মিঠু জানান, ১৯৯৮ সালের বন্যায় তিনি যে এলাকায় পানি আসতে দেখেননি, এবার সেই এলাকায় পানি এসেছে।
গত শনিবার থেকে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের এমলিতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আজিম। মোবাইল ফোনে তিনি জানান, পানি যেভাবে নামছে তাতে আগামী ৫ দিনেও বাড়ি যেতে পারব না।
লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ডাকাতিয়া সুরক্ষা আন্দোলনের পরিচালক আজম খাঁন, সবুজ বাংলাদেশের সহপরিচালক মো. শাহিন অভিযোগ করে বলেন, লক্ষ্মীপুর জেলার প্রায় ৯০টি খালের মধ্যে সবগুলোই নানাভাবে দখল হয়ে গেছে। সে কারণে মেঘনাপাড়ের উপকূলীয় জেলা হওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্মীপুর থেকে বন্যার পানি নেমে যেতে পারছে না। আমরা চাই এ জেলার প্রতিটি খাল যেন দখলমুক্ত হয়।
ফেনী থেকে সোলাইমান হাজারী জানান, ফেনী সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে বন্যার পানি কমে গেলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের। ভেসে গেছে অসংখ্য কাঁচা ও মাটির ঘর। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অনেক ঘরবাড়ি।
ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে বন্যাকবলিত ছয় উপজেলায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯১৪ কোটি টাকা। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধু ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নোয়াখালী শহরের বাসিন্দা সাইফুল হাসান জাহান জানান, নোয়াখালী জেলার প্রধান সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। তবে গ্রামীণ সড়কে এখনো পানি রয়েছে।
নোয়াখালী জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান খান জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত ৮ উপজেলা ও ৭টি পৌরসভায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র বেড়ে এক হাজার ৩৬৬টি দাঁড়িয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে দুই লাখ ৬৪হাজার ৭৪৩জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলায় ২১ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ মানুষ পানিবন্দি।
অন্যদিকে শুক্রবার বিকেলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীতে কিছু আশ্রয় কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়িতে যেতে শুরু করেছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান জানিয়েছেন, শুক্রবার দুপুরে বলেন, ফেনী ও নোয়াখালীর কয়েকটি এলাকার পানি লক্ষ্মীপুরের ওয়াপদাখাল ও ডাকাতিয়া নদীর মাধ্যমে মেঘনায় পতিত হয়। সে কারণে মূলত নোয়াখালীর পানির চাপ এখনো লক্ষ্মীপুর রয়েছে।
তিনি আরো জানান, নোয়াখালী ও ফেনীর পানি প্রবাহ কমে গেলে লক্ষ্মীপুরের পানি নামতে শুরু করবে। তবে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর জেলার সমতল থেকে ৬ সেমি পানি কমেছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাস কর্কর্তা ইদ্রিস মিয়া জানান, লক্ষ্মীপুর জেলাব্যাপী বন্যার যে অবস্থা রয়েছে তাতে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়ি ফেরার মতো এখনো উন্নতি হয়নি। এ জেলায় পানি নামছে খুবই ধীরগতিতে।
তিনি জানান, শুক্রবার পর্যন্ত ৪শ ১৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৪৯ হাজার ৫শ ৩১ জন বাসিন্দা রয়েছেন। এর বাহিরে আরো বহু মানুষ বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়ি রয়েছেন যার কোন হিসেব নেই। তিনি জানান, আগামী ২৪ ঘন্টায় যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে হয়তো সামান্য কিছু মানুষ বাড়িতে যেতে পারবে। তবে তাও নিশ্চিত নন।