এখনও ২৮ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নেই, প্রশাসনিক-একাডেমিক স্থবিরতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১ মাস অতিবাহিত হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। দেশের ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে উপাচার্য ছাড়াই। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক প্রশাসনিক ও একাডেমিক কর্মকাণ্ড।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি, রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "৫ আগস্টের পর মোট ৩৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখনও ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে উপাচার্য ছাড়াই।"
স্বায়ত্তশাসিত ৪টির মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে, ভিসি নিয়োগের প্রায় ১৫ দিন পর একাডেমিক কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, "বিগত আড়াই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা খাতের ক্ষতি হয়েছে এরকম বলার সুযোগ নেই, বরং সময়ের পেছনে পড়েছে। ইতোমধ্যে প্রশাসনিক কার্যক্রম সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক ধকলের পর বন্যাও একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে।"
"এখন হলগুলো মেরামত করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজাতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "একবার শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হলে, আশা করছি ১ মাসের মধ্যেই রিকভারি করা সম্ভব। জেলা পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়তো কয়েকমাস লাগতে পারে। এজন্য নতুন ইউজিসিকে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি বাড়াতে বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা রয়েছে; এখন শ্রেণিকক্ষে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে কোনো জ্যাম তৈরি হবে না।"
"এজন্য ভৌত অবকাঠামোর প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে ক্লাসের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে," যোগ করেন তিনি।
বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, নতুন প্রশাসন হয়তো পুরনো কাঠামোর ওপরেই থাকবে। তবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, "একটি পদ্ধতি ভাঙা সহজ, কিন্তু গড়ে তোলা কঠিন। এখন নতুন পদ্ধতি গড়ে তোলার সময়। বিগত দিনের ক্ষতি হয়তো কয়েকমাসের মধ্যেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়োপযোগী গতিশীল কাঠামো তৈরিতে সময় দিতে হবে।"
অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ড. মামুন আহমেদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বুয়েট এর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান এবং উপ-উপাচার্য হিসেবে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় চবির বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুর রহমান বলেন, "গত ১ মাস হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ক্লাস চালু হয়েছে, হলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চবিতে ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে, এখানে কোনো লোকজন থাকে না। শিক্ষার্থীদের কোনো পড়াশোনা নেই।"
তিনি বলেন, "আমরা চাই, অতি দ্রুত চবিতে দক্ষ, যোগ্য, শিক্ষার্থীবান্ধব এবং গবেষণাবান্ধব উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হোক।"
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের সাথে উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বরত শিক্ষকরাও পদত্যাগ করেছেন। ফলে গত ২৯ আগস্ট উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে ইউজিসি পরামর্শ দেয়।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও ট্রেজারারগণ পদত্যাগ করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরসহ অন্যান্য কর্মকর্তা পদত্যাগ না করা সত্ত্বেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। ফলে তাদের পদত্যাগ ও অনুপস্থিতিজনিত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
এতে আরো বলা হয়, প্রশাসনিক কার্যক্রম চলমান রাখা ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়মিত ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কাউন্সিল, ক্ষেত্রমতে বিভাগীয় চেয়ারম্যানগণের সঙ্গে আলোচনাক্রমে একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দিয়ে সাময়িকভাবে জরুরি প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে পরামর্শ প্রদান করা হলো।
এ পরামর্শ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিনিয়র ডিন ও অধ্যাপকের স্বাক্ষরে নিয়মিত আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজ সচল রাখার চেষ্টা করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত হিসাব নিয়ামক আমিরুল ইসলাম জানান, বেতন–ভাতা ঠিকমতো দিতে পারলেও অন্যান্য নিয়মিত আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজ স্বাভাবিকভাবে চলছে না। কারণ শীর্ষপদে কোনো ব্যক্তি দায়িত্বে নেই। দ্রুত এই অচলাবস্থা দূর করা দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই অবস্থা যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ আনিছুর রহমান।
উপাচার্যহীন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদত্যাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ও অন্যান্য রুটিন প্রশাসনিক কাজে সমস্যা হচ্ছিল। তবে এখন কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপকের সমন্বয়ের মাধ্যমে সেগুলোর সুরাহা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, "বেতন প্রদানে বিলম্ব হলেও সেটি পরবর্তীতে সমাধান হয়েছে। এখন পর্যন্ত এভাবেই চলমান আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম।"
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) খালেদা আক্তার বলেন, "যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বরতরা পদত্যাগ করেছেন, সেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। আজকেও কয়েকটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দ্রুতই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনিক শূন্যতা দূর করা হবে।"
এ বিষয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উচ্চ প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডে দখলদারিত্বের রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের প্রথম মাসে দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য মহোদয়গণ পদত্যাগ করেছেন। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। প্রথম মাসে আমরা ক্রমাগতভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। এর ফলে সকল সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।"
প্রসঙ্গত, গত ১৭ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ আগস্ট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যদিও এখনো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোদমে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি।
এর আগে, গত ১ জুলাই থেকে শিক্ষকদের পেনশন স্কিম আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৭০ দিনেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম।