শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো, এবার কী হবে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আজ বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গত ৫ আগস্ট তিনি দেশ ছেড়ে পালানোর পর, ১৪ আগস্ট তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই মামলাটি করা হয়।
এবার কী হবে?
জানা যায়, পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতেই অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। তবে এখনও পর্যন্ত তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্রয় দেয়নি ভারত।
ঢাকা এখন শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে প্রত্যর্পণ করতে চাইছে। এজন্য ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় নয়াদিল্লির কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাবে ঢাকা।
পরিহাসের বিষয় হলো, ২০১৩ সালে হাসিনা সরকারই এই চুক্তি সই করেছিল।
কিন্তু চুক্তিটির কি প্রয়োজনীয় আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
চুক্তির ১ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ ও ভারতে যারা নিজ দেশে প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে (ভারতীয় ও বাংলাদেশের আইনে কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ডের শাস্তিযোগ্য অপরাধ) দোষী সাব্যস্ত হয়, শুধু তাদেরই অন্য দেশের কাছে প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া এই ধরনের অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছাড়াও বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার অপরাধ প্রমাণ করার দায়িত্ব বাংলাদেশের আদালতের নয়। তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনাই তাদের জন্য যথেষ্ট।
সংশোধিত চুক্তির ১০(৩) ধারায় বলা হয়েছিল, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না-করলেও চলবে – শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি করা হয়েছে।
ভাগ্যের পরিহাস হলো, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ আমলে করা সংশোধনীর আগে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশের সেই সব অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করার বাধ্যবাধকতা ছিল।
তবে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার জন্য এটি বাতিল করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাকে ১৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত মাসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হাসান বলেন, 'আমাদের দেশের আইন-আদালত যদি তাকে (শেখ হাসিনা) ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে বলে, তাহলে সে ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।'
তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, 'তবে ভারত ফেরত দেবে কি না সেটা তাদের ব্যাপার। তাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে, সে অনুযায়ী ভারত চাইলে ফেরত দিতে পারার কথা।'
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অনুরোধ করলে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ভারতের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু ফাঁকফোঁকরও রয়েছে।
নিয়মের ব্যতিক্রম
দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে এমন কিছু ধারা আছে যেগুলো প্রয়োগ করে অনুরোধ পাওয়া দেশ তা খারিজ করার অধিকার রাখে।
উদাহরণস্বরূপ, অনুচ্ছেদ ৬- এ বলা হয়েছে, যাকে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা যদি 'রাজনৈতিক প্রকৃতি'র হয় তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে।
তবে সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদে কোন কোন অপরাধের অভিযোগকে 'রাজনৈতিক' বলা যাবে না, সেই তালিকাও বেশ লম্বা – এর মধ্যে হত্যা, গুম, অনিচ্ছাকৃত হত্যা ঘটানো, বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো ও সন্ত্রাসবাদের মতো নানা অপরাধ আছে।
এছাড়া, অনুরোধ পাওয়া দেশেও যদি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও 'প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে'র মামলা চলে তাহলে সেটা দেখিয়ে অন্য দেশের অনুরোধ খারিজ করা যায়।
অর্থাৎ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ভারতের কোনো আদালতে কোনো 'প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে'র মামলা চলে, তাহলে সেটা দেখিয়েও অন্য দেশের প্রত্যর্পণের অনুরোধ খারিজ করা যায়।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য এটা প্রযোজ্য নয়। কারণ ভারতে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হচ্ছে না বা অচিরে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
এছাড়া, চুক্তির ৮(১)(ক)(৩) অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হতে পারে।
ধারাটি হলো, যদি অনুরোধ পাওয়া দেশের মনে হয় 'অভিযোগগুলো শুধুমাত্র ন্যায় বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি' – তাহলেও তাদের সেটি নাকচ করার ক্ষমতা থাকবে।
এতে বলা হয়েছে, যদি প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা ব্যক্তি অনুরোধকৃত রাষ্ট্রকে বোঝাতে পারেন যে তাকে প্রত্যর্পণ করা অন্যায় বা নিপীড়নমূলক হবে'; কারণ 'তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সরল বিশ্বাসে' করা হয়নি; তাহলে ওই ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা হবে না।
উল্লেখ্য, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়কে জনতা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলেও, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে আদালতে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ডিম নিক্ষেপ করেন।
সম্প্রতি গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করা হলে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকেরও ওপরও হামলা চালানো হয়।
শেখ হাসিনার পদচ্যুতির ধরন দেখে এ ক্ষেত্রে ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
এরই মধ্যে দেশে বিরাজমান প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, যা আওয়ামী লীগ আমলেরই প্রতিচ্ছবি।
এটিও উল্লেখযোগ্য যে, প্রত্যর্পণ চুক্তিতে কোনো বাধ্যতামূলক বিচারিক প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা নেই, যার ফলে পক্ষগুলোকে তাদের মতবিরোধগুলো বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তের জন্য একটি স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের কাছে উপস্থাপন করার সুযোগ নেই।
এই ক্ষেত্রে একটি অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে, যদি উভয় পক্ষই বিশেষত অনুচ্ছেদ ৮ নিয়ে; নিজেদের মতো করে ব্যাখা দিতে থাকে।
বাংলাদেশের জন্য এটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি যে, বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তি সহযোগিতার একটি আইনি কাঠামো হিসেবে কাজ করে।
আইনি চ্যালেঞ্জ ছাড়াও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ উঠতে পারে, বিশেষ করে অভিযোগগুলোর রাজনৈতিক প্রকৃতি এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো ঘিরে। এরপরের বিষয়গুলো দুই দেশের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার মাধ্যমেই মীমাংসা করতে হবে।
শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হলেও, তিনি এখনও আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন।
আশ্রয় কী কোনো বিকল্প হতে পারে?
জানা গেছে, শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। আশ্রয়প্রার্থীদের এই দাবির কোনো আইনি অধিকার নেই এবং কোনো দেশেরই তা মঞ্জুর করার বাধ্যবাধকতা নেই।
আশ্রয়ের চারটি ধরন রয়েছে: আঞ্চলিক, বহিরাগত, নিরপেক্ষ ও অস্থায়ী।
আঞ্চলিক আশ্রয় হলো দেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আশ্রয় দান। রাষ্ট্রদ্রোহ ও গুপ্তচরবৃত্তির মতো রাজনৈতিক অপরাধের অভিযোগের বিচার থেকে বাঁচতে, নিজ দেশে প্রত্যর্পণ থেকে কোনো ব্যক্তিকে রক্ষায় ব্যবহৃত হয় এই উপায়টি। এটি রাজনৈতিক আশ্রয় হিসেবে পরিচিত।
বহিরাগত আশ্রয় বলতে বিদেশি ভূখণ্ডে অবস্থিত দূতাবাস, কনস্যুলেট, যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজে প্রদত্ত আশ্রয়কে বোঝায়, যা কূটনৈতিক আশ্রয় নামেও পরিচিত।
সাধারণত যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দেশগুলো নিরপেক্ষ আশ্রয় দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর সৈন্যদের এই শর্তে আশ্রয় দেওয়া হয় যে, তারা যুদ্ধ চলাকালীন সময় বন্দি থাকতে সম্মত থাকবে।
এদিকে, অস্থায়ী আশ্রয় হলো এমন ব্যক্তিদের দেওয়া সুরক্ষার একটি অস্থায়ী রূপ, যারা তাত্ক্ষণিক বিপদ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন তবে সম্পূর্ণ শরণার্থী মর্যাদার জন্য যোগ্য নাও হতে পারেন। এই ধরনের আশ্রয় সাধারণত গণ বাস্তুচ্যুতির পরিস্থিতিতে দেওয়া হয়। যেমন- সশস্ত্র সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, যেখানে স্বগতিক দেশ দুর্যোগকবলিত ব্যক্তিদের নিাপদে নিজ দেশে ফেরা পর্যন্ত আশ্রয় দেয়।
এছাড়া আশ্রয়ের আরেকটি ধরন হলো ফৌজদারি আশ্রয়। এটিকে 'অপরাধী এবং ঋণখেলাপিদের আশ্রয় দানকারী আশ্রয় এবং সুরক্ষার অলঙ্ঘনীয় স্থান'- হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
আশা করা হচ্ছে, শেখ হাসিনা উপরোক্ত আশ্রয় চাইতে পারেন। তবে এটি কীভাবে কার্যকর হতে পারে, তা এখন দেখার বিষয়।