চট্টগ্রামের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি টিকে আছে প্রশাসনের মদদেই
গত শুক্রবার পাহাড় ধস হওয়া এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বাস করেন পোশাক শ্রমিক মোহাম্মদ সাজ্জাদ। ২০২০ সাল থেকে এখানে থাকেন তিনি।
"স্বল্প বেতনে চাকরি করি। বাসা ভাড়া কম, তাই ঝুঁকি জেনেও এখানে থাকতে হচ্ছে।"
চট্টগ্রামের ৩৪টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে এভাবেই মৃত্যুকে সঙ্গী করে বাস করছেন প্রায় এক লাখ মানুষ। যারা নগরে এসে মাথা গোজার ঠাঁই পায়না, এমন দরিদ্র পরিবারগুলো সস্তায় বাসা ভাড়া নেয় পাহাড়ে।
২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানি পর এমন বিপর্যয় ঠেকাতে তদন্ত কমিটিগুলো মোট ৭২ টি সুপারিশ করে; যার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি গত ১৫ বছরে। এক যুগ আগে যে শবযাত্রা শুরু হয়েছিল এ পর্যন্ত তা ২০৯ জনে গিয়ে ঠেকেছে।
শুক্রবার মধ্যরাতে আকবর শাহ থানার বরিশাল ঘোনা ১ নম্বর ঝিল পাড় এলাকায় পাহাড় ধসে দুই বোন নিহত হন। আহত হন তাদের মা-বাবা। এছাড়া বিজয় নগর এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হন আরও দুইজন। নিহতদের সবাই দরিদ্র পোশাক শ্রমিক।
এ মর্মান্তিক ঘটনার পর সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বারবার বলার পরও পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনকারীরা সরেনি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ে মৃত্যুর ওই ফাঁদ সেবা সংস্থাগুলোরই তৈরি করা।
যে দুটি স্থানে পাহাড় ধস চারজনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে যাওয়ার জন্য রাস্তা নির্মাণ করেছে সিটি করপোরেশনই। আছে বিদ্যুৎ পানি ও গ্যাস সংযোগ।
৩৪ পাহাড়ে হাজারো দখলদার, মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস লাখো মানুষের
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বাস করছে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১; বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সরকারি সাত পাহাড়ে এ সংখ্যা ৩০৪।
তবে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নগরীর লালখান বাজার, মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, পাহাড়তলি, কৈবল্যধাম, খুলশী, বায়েজিদ, আকবর শাহ, জঙ্গল ছলিমপুরসহ নগরের ৩৪ পাহাড়ে কয়েক হাজার পাকা, সেমি পাকা ও কাঁচা স্থাপনায় বর্তমানে অবৈধ বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি।
শুক্রবার ফয়'স লেকে পাহাড়ধসের যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে; সেখানকার পাহাড়গুলো সরকারি মালিকানাধীন। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে ওই কলোনি। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার সিন্ডিকেট এই কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। সেবা সংস্থাগুলোর সহযোগীতায় ওইসব অবৈধ বস্তিতে দেওয়া হয়েছে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ।
পাশের এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে পাকা ঘরও; যেখানে ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি এলাকায় দেখা গেছে গ্যাস সংযোগও। মূলত অল্প খরচে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সুবিধা থাকায় এসব মৃত্যুকূপে ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছেন।
শুধু মাত্র পূর্ব ফিরোজশাহ এলাকায় রেলের ৩৩৬ দশমিক ৬১ একর জমি দখলে নিয়েছেন ৩০০ দখলদার। এদের নিয়ন্ত্রণে বাস করে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই এলাকার পাহাড়ের ঢালে এক কাঠা জমি ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আর পাহাড়ের নিচে প্রতি কাঠা ২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। জাল স্ট্যাম্পে চলে এসব পাহাড়ের কেনাবেচা।
স্থানীয় কাউন্সিল জহুরুল আলম জসিম টিবিএসকে বলেন, 'ফয়েজ লেকের এক নম্বর ও দুই নম্বর ঝিল এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে ও নিচে ৫০ হাজারের বেশি লোক বসবাস করে। সেখানে বিভিন্ন এনজিও এবং সংস্থা সড়ক ও পানির লাইনের ব্যবস্থা করেছে। পাহাড়ের বাসিন্দাদের বারবার সরে যেতে বলা হলেও তারা সরেনি।'
এ কাউন্সিররের অভিযোগ, 'বিভিন্ন পাহাড়ের মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটসহ এবং সেবা সংস্থাগুলোর পাল্টাপাল্টি দোষারোপের সুযোগ নিচ্ছে দখলকারিরা।'
পাহাড়ে অবৈধ বসতিতে বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবি'র চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা প্রশাসন যেখানে বলে আমরা সেখানে কাজ করি।'
পাহাড় ধস বন্ধে সুপারিশ শুধু কাগজে-কলমেই
২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের পৃথক সাতটি স্থানে পাহাড় ধসসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাঁদের সুপারিশে লিখেছিলো, 'পাহাড়ের পাদদেশে খুবই ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। যে কোনো সময় ব্যাপক প্রাণহানিসহ মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই এক্ষুণি এই এলাকা দখলমুক্ত করা জরুরি'।
শনিবার ছিলো সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ১৫ বছর পূর্তি। ওই দিনেই আবারও পাহাড়ধসে প্রাণ গেছে চারজনের। অথচ ১৫ বছর আগে করা সুপারিশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
২০০৭ সালে তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গঠিত কমিটি দুটি ৫০টি সুপারিশ করে। একই ঘটনায় সিডিএমপির (সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি) পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক মাকসুদ কামালকে প্রধান করেও গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এ কমিটির ২২ দফা সুপারিশ ছিল।
তদন্ত কমিটিগুলোর দেওয়া মোট ৭২ টি সুপারিশের মধ্যে ছিলো- পাহাড়ে জরুরি বনায়ন, গাইডওয়াল নির্মাণ, পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ, নতুন বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা এবং পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ। যার একটিও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কেবল বর্ষা মৌসুমের তোড়জোড়ে চট্টগ্রামে পাহাড় ধস আর প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব না। প্রশাসনের অপেশাদারিত্ব, রাজনীতিবিদদের নির্লিপ্ততা ও সরকারি সংস্থাগুলার সমন্বয়হীনতায় এ সংকট আরও বেড়েছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আর বৃষ্টি হলেই বাসিন্দাদের নেমে আসার জন্য মাইকিং, আশ্রয়কেন্দ্র খোলা-এসব এক ধরনের প্রহসন।'
'একটা শ্রেণি চায় না অবৈধ বসবাসকারীরা পাহাড় থেকে নেমে আসুক। নেমে আসলে পাহাড় দখলের প্রক্রিয়াটা থেমে যাবে', বলেন অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী।
চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, 'পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করতে গেলে একটির পর একটি রিট হয়। শুধু মতিঝর্ণা পাহাড়েই আছে সাতটি রিট। পুরো শহরে এমন অসংখ্য রিট রয়েছে। এসব রিট না থাকলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সহজ হতো।'