জনগণকে স্যালুট প্রধানমন্ত্রীর, খুলল পদ্মা সেতু
মাওয়া, মেঘলা সকাল। দিগন্তে তখন বর্ষার বৃষ্টি নামি নামি করছে। তার মাঝেই চলছে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের তোড়জোড়। তবে এই বর্ষায়ও, অন্তত সেতু উদ্বোধন হওয়ার আগপর্যন্ত, নামার সাহস করত না বৃষ্টিধারা।
কারণ আজকের দিনটা আর দশটা দিনের চেয়ে আলাদা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ। আজকের দিনটি বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়, দেশের মানুষের অদম্য মনোভাবকে উদযাপন করার দিন। আজকের দিন সমালোচকদের—যাদের অনেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধী ছিল, অনেকে প্রকল্পটির ব্যর্থতা কামনা করত—সমুচিত জবাব দেওয়ার দিন।
সমস্ত জল্পনা-কল্পনা-রটনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে—১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার ২৪ বছর পর—পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুটির স্বপ্নদ্রষ্টাদের—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা—পেইন্টিংসংবলিত একটি ম্যুরালও উন্মোচন করেন তিনি।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাখা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছি, আমরাও পারি।'
'পদ্মা সেতু তাই শুধু বাঙালির আত্মমর্যাদা ও সামর্থ্য প্রমাণের সেতুই নয়, সমগ্র জাতির প্রতি অপমানের প্রতিশোধও বটে। বাংলাদেশের জনগণই আমার সাহসের উৎস। আমি তাদের স্যালুট জানাই,' বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সব প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক, ঠিকাদার, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে স্মরণ করে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু নির্মাণের সাথে জড়িত যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন তিনি।
পদ্মা সেতুর দুই পারের যেসব বাসিন্দাদেরও জমি ও বাড়ি সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদেরও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
একটা কথা প্রচলিত আছে, ওপরে উঠতে যত কষ্ট হয়, সেখান থেকে আশপাশের দৃশ্যও ততই উপভোগ করা যায়। ব্রিজের প্রথম টোল পরিশোধের পর মার্সিডিজ মেব্যাচ থেকে নেমে যখন প্রমত্তা পদ্মার দিগন্তে চোখ রাখলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনে নিশ্চয় এই কথাটাই চলছিল। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তখন বাংলাদেশের লাল-সবুজের মেঘ দিয়ে বর্ষার মেঘকে তাড়াচ্ছে।
তার পিতার স্বপ্ন, বাংলাদেশের লাখো মানুষের আশা এবং তার, তার সহযোগী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অধ্যবসায় অবশেষে বাস্তব রূপ নিয়েছে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ অনেক দিক থেকেই এক অসাধারণ কীর্তি। প্রথমত, বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদীর ওপর—যে নদীতে বিপুল পরিমাণ পলি জমে—সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে গভীর পাইল (১২৮ মিটার) বসানো হয়েছে। গভীর এই পাইলিং প্রকৌশল-বিস্ময়েরই সমতুল্য।
এছাড়া সেতুটি দক্ষিণবঙ্গকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। পাশাপাশি আগামী বছরগুলোতে দেশের সার্বিক জিডিপি ১.২৩ শতাংশ বাড়াবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাপার হলো, ফেরির অপেক্ষায় বসে থেকে বহু মানুষ মারা গেছে; তাই সেতুটি অগণিত জীবন বাঁচাতে পারে। কিছুটা বাড়তি ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও পদ্মা সেতু বাংলাদেশের এক যুগান্তকারী অর্জন হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নিন্দুকরা বলছিল, কেবল সরকারি কর্মকর্তা বা দলীয় নেতারাই সেতুটির উদ্বোধন নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে একেবারে উল্টোটা—আবেগে, উচ্ছ্বাসে মেতেছে সাধারণ জনতা। বাগেরহাট থেকে থেকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখতে এসেছিলেন ৫১ বছর বয়সি মিরকাত শেখ। সেতু নির্মাণের জন্য নিজের জমি ছেড়ে দিয়ে বাগেরহাটে পুনর্বাসিত হতে হয়েছে তাকে। মিরকাত শেখসহ সর্বশ্রেণির মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন স্বচক্ষে এই সেতু উদ্বোধনের মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য।
মিরকাত বলছিলেন, 'আমি গ্রাম্য ডাক্তার, প্রায়ই ঢাকায় যাই। রাজধানীতে পৌঁছতে আমার অন্তত ৫-৭ ঘণ্টা লেগে যেত। কিন্তু এখন সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন ঢাকা থেকে দিনে দিনেই বাড়ি ফিরতে পারব।'
তবে সাধারণ মানুষের লাগামহীন উত্তেজনা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় প্রথমবারের মতো সেতুতে হাঁটার জন্য প্রতিরক্ষামূলক বাধাগুলোকে আক্ষরিক অর্থেই ঝড়ের মতো টপকে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের সেতুতে উঠে পড়ার ঘটনা থেকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে আসা মানুষকে নিরাপত্তা বেষ্টনী টপকে সেতুতে উঠে পড়তে দেখা গেছে। এছাড়াও অনেকেই লঞ্চ ও ট্রলার ভাড়া করে চলে এসেছিলেন শুধু সেতুর উদ্বোধন দেখবার জন্য।
এই উৎসাহী ব্যক্তিদের একজন মিন্টু। বন্ধুদের সঙ্গে কাঁটাতারের বেষ্টনী পেরিয়ে সেতুতে উঠে পড়েছিলেন তিনিও।
মিন্টু বলেন, 'আমরা যহন দেখলাম একটা-দুইডা গাড়ি যাইতাছে, তখনই ঠিক করলাম যেমনেই হোক বিরিজে উঠমু।'
কিন্তু অর্ধেক রাস্তা পার হওয়ার পরই পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে মিন্টু ও তার বন্ধুদের সেতু থেকে নামিয়ে দেয়। কিন্তু মার খাওয়ার পরও কোনো আফসোস নেই বলে জানান মিন্টু।
'আইজকা বিরিজে না উঠলে কইলজা ফাইট্যা মইরাই যাইতাম!' বলেন তিনি।
উদযাপন শুধু সেতুর আশেপাশের এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে।
ঐতিহাসিক দিনটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মিছিল, সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কনসার্টসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করে। পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি প্রজেক্টর ব্যবহার করে সারা দেশে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে উল্লাসে ফেটে পড়ছিল জনতা। যারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি তাদের জন্য কয়েকটি শহরে প্রতীকী পদ্মা সেতু তৈরি করা হয়।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসা কুড়িয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি থেকে শুরু করে মার্কিন দূতাবাস পর্যন্ত সবাই এই বিশাল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। এমনকি প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ঘুষ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে ২০১২ সালে প্রকল্পের তহবিল বাতিল করা বিশ্বব্যাংকও পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের দায়বদ্ধতাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
এই পথপরিক্রমা যে সর্বদা ফুলেল ও প্রশংসাপূর্ণ ছিল না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পথচলা ছিল নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরপুর। একে তো পদ্মা বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী, তার ওপর একটি মেগা প্রকল্পে নিজস্ব অর্থায়নের ঝুঁকি তো ছিলই। এই যাত্রা যে বাধায় পরিপূর্ণ ছিল, তা প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার আবেগপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী উদ্বোধনী বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া অনেকগুলো গোষ্ঠীর কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ—পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সেতুর নির্মাণ পর্যন্ত—বিলম্বিত হয়েছে ও অনেকবার পরীক্ষার মুখে পড়েছে।
প্রথমত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার না হলে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট অস্থির হয়ে না উঠলে আমরা হয়তো অনেক আগেই এই দিনটি উদযাপন করতে পারতাম। পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার কথাও ছিল জাপানের। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর অকালমৃত্যুর কারণে পরের ২৫ বছরে এর কোনোটাই আর হয়নি।
তেইশ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০০১ সালে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। ২০১১ সালে এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক নবনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ১.২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিও স্বাক্ষর করে।
কিন্তু পদ্মা সেতু তো আজন্ম দুঃখী, তাই বিশ্বব্যাংক প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। ফলে প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়নি—এই দাবিতে আওয়ামী লীগ সরকার অনড় থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সংস্থাটি সরে যায়। ২০১২ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ঘোষণায় কেঁপে ওঠে গোটা দেশ। তিনি ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে।
প্রত্যাশিতভাবেই হাতেগোনা অল্প কয়েকজন মানুষই কেবল ভাবতে পেরেছিলেন যে এমন সাহসী স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, তা-ও আবার উন্নয়নের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত দেশে।
কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে—এবং একাধিকবার বিলম্ব, সংশোধন, নকশার ত্রুটি ও পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও—শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের জনগণই আজ বিজয়ী হিসেবে নাম লিখিয়েছে। প্রমত্তা পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে মোটর গাড়ির প্রথম বহর মাওয়া থেকে জাজিরায় পৌঁছেছে।
একেক শ্রেণির মানুষের কাছে পদ্মা সেতুর তাৎপর্য একেক রকম। অর্থনীতিবিদদের কাছে এটি ট্রান্স-এশিয়ান সম্ভাবনা-সংবলিত আঞ্চলিক সংযোগ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতীক। দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কাছে সেতুটি স্বচ্ছন্দ, নির্বিঘ্ন ও সহজ যোগাযোগের প্রতীক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী বক্তব্যে যেমনটা বলেছেন, পদ্মা সেতু স্বনির্ভরতার প্রতীক এবং আমাদের চিরন্তন, অদম্য মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।