অতি ভোগলিপ্সা কি দুর্নীতি-প্রিয়তার একটি বড় কারণ?
সমাজে দুর্নীতি সর্বগ্রাহী হয়ে উঠেছে। দুর্নীতিবাজেরা একসময় লজ্জা পেত, মাথা নিঁচু করে চলতো। আজ তারা মাথা উঁচু করে চলেন, সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে(!) তারা সামনে পিছে পুলিশ প্রহরা নিয়ে চলেন। আজ যিনি দুর্নীতিবাজ নন তিনি তার স্বীয় অক্ষমতার জন্য নিজে অনুতপ্ত বোধ করেন, নিজেকে প্রকারন্তরে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করান। সমাজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে এমন এক যায়গায় পৌঁছেছে যে দুর্নীতি এবং অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন করা সর্বজনগ্রাহ্যতা (?) পেয়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মানসপটে আজ এই ছবি অঙ্কিত হয়েছে যে অপরাধ কোন খারাপ কাজ নয়, দুর্নীতি কোন সমাজ বিরোধী কাজ নয় বরং দুর্নীতি না করলে বড় (?) হওয়ার আর কোন পথ নেই।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা সামগ্রিক অর্থে সমাজের জন্য শুধু ক্ষতিকর বললে ভুল হবে, বরং এটা সমাজকে সমূলে ধ্বংস করার দিকে ধাবিত করছে। অচিরেই হয়ত আমরা এই দেশের সমস্ত পরিকাঠামো, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ পুরা সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া প্রত্যক্ষ করবো। আমরা দিনে দিনে ভীতু ও আতংকিত হয়ে পড়ছি, শুধু করোনার কারণে নয়, বরং মানুষের নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় এবং সামাজিক-রাস্ত্রীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার তীব্র আশংকার কারণে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব ভয় হচ্ছে। স্বাধীনতার গর্ব কি আমরা হারিয়ে ফেলছি, স্বাধীনতার অহংকার আমরা ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছি? যে স্বাধীনতা আমাদের গর্বের জায়গা, যে স্বাধীনতা আমাদের অহংকারের আলোক-শিখা সেই স্বাধীনতার মূলনীতি, স্বাধীনতার মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশের প্রতি অঙ্গীকার, সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার মূল স্তম্ভ কি আমরা ভেঙে ফেলার কাজে লেগে পড়েছি? পৃথিবীতে এমন দেশপ্রেমে পূর্ণ ও দেশপ্রেমহীন জাতি সত্যি বিরল, আত্ম-বিস্মৃত জাতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এদেশে প্রচুর দেশপ্রেমিক মানুষ অবশ্যই আছেন যারা এখন হয়ত ঘুমিয়ে নয়ত তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আছেন, যাদের প্রকৃত জাগরণ দেশের মঙ্গলের জন্য খুব দরকার। আমরা সব থাকতেও দরিদ্র, হতদরিদ্র- মেধায় মননে, সততায়, নিষ্ঠায় ও জাগরণে। আমাদের উত্তরণ প্রয়োজন, ঘুমন্ত ভালমানুষের কণ্ঠকে জাগ্রত হওয়া দরকার; দেশের কল্যাণে, মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্য।
সাগরের তলদেশ আমরা দেখিনা কারন উপরটা পানিতে পূর্ণ থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের দেশের প্রকৃত অবস্থা দেখতে পেতাম না যদি করোনার মত অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস আমাদের সংক্রমিত না করত। আমাদের দেশের প্রকৃত অবস্থা এত নাজুক তা শুধু উদাহরণস্বরূপ স্বাস্থ্যখাতের চেহারার দিকে দৃষ্টি দিলেই অনুমান করা যায়। সরকারের সব খাতেই এই ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বিদ্যমান বলেই অনুমান করতে কষ্ট হয়না।
প্রশ্নটি করতে লজ্জাবোধ করি একজন সাধারন নাগরিক হিসেবে তবুও করতে ইচ্ছে করে। আমরা পুরা জাতি কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি ? অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহ্য করে তাদের অপরাধতো একই এবং সেই কারণে বলতে হয় যে আমরা ধীরে ধীরে নষ্টের দিকে ধাবিত হচ্ছি যা থেকে আমাদের বের হয়ে আসাটা জরুরি। নিজেদের জন্য না হোক, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে।
মানুষ কেন অপরাধ-প্রবণ হয়ে ওঠে সেটা হয়ত বিচার করবে অপরাধবিজ্ঞান কিন্তু অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে কিছু বিষয়ের অবতারণা করাটা বোধহয় আমার জন্য অন্যায় হবে না। ভোগের প্রতি আগ্রহ মানুষের সহজাত। প্রতিটি ভোগেই জড়িয়ে থাকে তৃপ্তির বিষয়টি। তৃপ্তির পরিমাণ পরিমাপ করা খুব দুরূহ। কোন ক্ষুধার্ত মানুষ যখন খাবার সামনে পায় তখন সে বেশি খায়। খেয়ে তাঁর ক্ষুধা মিটে গেলে আর খায়না। খাবারের জন্য মানুষের যে আগ্রহ সেটা বজায় থাকে বটে কিন্তু একবারে সে খুব বেশি খাবার খেতে পারেনা। তবে খাবারের জন্য যদি কেউ পাঁচতারা হোটেলে যান, দামি দামি রেস্তরাতে যান প্রতিনিয়ত তাহলে ভিন্ন কথা। তখন খাবারের পেছনে তার খরচ বেড়ে যায়। যে খাবার বাসায় রান্না করে খেলে ১০০ টাকায় সারা যায় সেই একই খাবার পাঁচতারা হোটেলে খেলে ১০০০ টাকা লেগে যায়। শুধু খাবারের প্রতি লোভ একটা পরিবারকে তাদের আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, ঋণের জালে জড়িয়ে আটকে ফেলতে পারে। ভোগের তালিকায় শুধু খাবার থাকলে তাও মানুষ সামাল দিতে পারতো কিন্তু মনুষ্য-ভোগের তালিকাটা অনেক দীর্ঘ। মানুষের প্রয়োজনে যতকিছু দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান জিনিস আছে তার সবকিছুই বিভিন্ন আঙ্গিকে তার ভোগের বিষয়; সব যে মানুষের পেটে যায় তা নয়, কিছু যায় শরীরের পরিধানে, কিছু চোখের দৃষ্টিতে, কিছু মগজের চিন্তায় ইত্যাদি।
সম্প্রতি করোনাকালীন অবস্থায় আমরা দেখছি যারা অপরাধী তাদের চোখ-কান-মস্তিস্ক সব পচে গেছে, তারা জীবন রহিত ও বিবেক বর্জিত এক জীব মাত্র। মহামারী বা অতিমারী, মানব জাতির জন্য যা মহাবিপদ হিসেবে আবির্ভূত তা-ও তাদেরকে অপরাধ-কর্মকাণ্ড থেকে রহিত করেনা বরং তারা এটাকে একটা অপূর্ব সুযোগ হিসেবে ধরে নিয়ে কেউ-জানতে-পারবে-না এই মানসে তাদের স্বীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে চলেছে। আরও অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমরা দেখি রাষ্ট্রের কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছেন। যখন বিষয়টি সবার সম্মুখে এসে পড়েছে তখন সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বাচ্চাছেলেমেয়েদের মত সব অস্বীকার করছে এবং তারা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছেন যে দেশের মানুষ এইসব গালগল্প বিশ্বাস করছেন।
সচেতন মহলের ধারণা যারা অপরাধ করছে তারা অপরাধী হয়েছে মূলত রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায়। দেখা যাচ্ছে এমন এমন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির বিষয় গোচরীভূত হচ্ছে যার সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সংশ্লিষ্টতা বা মদদ ছাড়া সেইসব দুর্নীতি করা কোনভাবে সম্ভব নয়। আমরা যখন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির মুখে শুনি যে তিনি রিজেন্ট হাসপাতালকে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছেন প্রাক্তন একজন সচিবের মৌখিক নির্দেশে তখন আমরা হাসব না কাঁদব সে কথাই ভুলে যাই। সবাইকে মনে চাপা কষ্ট নিয়ে এই রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে এই ধরণের অসত-মূর্খতার চতুরতায় মুখে চাপা হাসি হাসতে হয়। আবার যখন দেখা যায় সেই চুক্তি সই অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রীসহ আধা-ডজন খানেক সচিব তখন চোখ কপালে ওঠা ছাড়া উপায় থাকেনা। কারণ এমন একটা চুক্তি সবার সামনে সই হচ্ছে যার কোণ লিখিত আদেশ নেই। এবং এই মন্ত্রী-সচিবেরা এতটাই বেখেয়ালি যে কেউ কিছু জানেন না এবং জানার চেষ্টাও করেন না। সবাই হাজির হয়েছিলেন ফটোসেশনের (!) জন্যে। আমাদের দেশের অবস্থা কি এতটাই নাজুক? এখানে সুস্থ্ বুদ্ধি সম্পন্ন লোকের এত অভাব! মাননীয় উনারা(!!) কি জড় বুদ্ধিসম্পন্ন? নাকি উনারা অতি উঁচু মানের বুদ্ধিমান(!) ? সত্যি কথা হচ্ছে উনাদের মত ভদ্রলোকেরা এই রাষ্ট্রের টাকা পয়সা দিয়ে লেখাপড়া শিখে দেশের ও দেশের মানুষের সর্বাঙ্গীণ ক্ষতি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। অন্যায়কারী যে-ই হোক তাঁদের সমূলে উৎপাটন জরুরী এই দেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
ভোগের প্রসঙ্গ কেন আনা হল এখানে সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। আমরা গ্লোবাল ভিলেজের সদস্য হবার কারণে পৃথিবীর তাবৎ পণ্য সামগ্রীতে আমাদের প্রবেশাধিকার জন্মেছে। উন্নত দেশের আদলে আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে হোটেল, রেস্তরা, কফি শপ, গেস্ট হাউস ইত্যাদি। গড়ে উঠেছে বড় বড় শপিং মল, দামি বিদেশী গাড়ীসহ অন্যান্য ভোগ্য সামগ্রীর আমদানি সহজ লভ্য হয়েছে। দামি স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে অনেককিছুই নেই কিন্তু যেহেতু Demonstration Effects বা প্রদর্শন প্রভাবের কারণে সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে ভোগ/ক্রয় করার স্পৃহা জন্মে সেজন্য অনেকেই সেই প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারছেন না।
সৎ পথের আয়ে যারা তাঁদের সেই কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা সেবা ক্রয় করতে পারেন না তাঁরা চেষ্টা করেন অন্যপথ ধরার। (সবাই যে এই কাজে যুক্ত সেটা ঠিক নয়।) আর সেখানে যদি সমাজে জবাবদিহিতার অভাব থাকে, অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করার উদাহরণ কম থাকে বা না থাকে এবং সরকারি-বেসরকারি সবাই একই দুষ্ট রোগে আক্রান্ত থাকে তাহলে সবাই মিলে অপরাধের একটা সর্বগ্রাসী স্রোতের মধ্যে শামিল হয়ে যায়। কে কতটা বেশি ভোগ করতে পারে, কে বেশি দামি ও ব্রান্ডেড জিনিস পরতে পারেন, কে বেশি দামি গাড়ি চড়তে পারেন, কে ছেলেমেয়েকে দেশে বিদেশে দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেন ইত্যাদি এই প্রতিযোগিতায় সবাই যুক্ত হয়ে যান। এই বাস্তবতা এখন আমাদের দেশে।
নিজের পায়ে আমরা নিজেরা কুড়াল মারছি। আমরা খুব ভোগ লিপ্সু ও লোভী হয়ে পড়েছি। এই সর্বগ্রাসী লোভ মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয়কে ভুলিয়ে দিচ্ছে। এই অপরিসীম ভোগ লিপ্সা, সাধ্যের বাইরে চলার সংস্কৃতি, নিজের লোভকে সংবরণ করতে পারার অক্ষমতা এবং সমাজের সর্বস্তরে অপরাধসঙ্কুল অবস্থা পরিবর্তনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারার অক্ষমতা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও নিপীড়নের মধ্যে ফেলে দেবে। আমরা কি চাইনা আমাদের দেশ ও পরবর্তী প্রজন্ম একটা ভাল আবাসভূমি উপহার হিসেবে পাক তাঁদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে?
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।