অনেকের ওপরেই ক্ষমতার ভূত এখনো ভর করে আছে
সামন্ত ব্যবস্থা বা জমিদারি প্রথা অনেক আগে বিলুপ্ত হলেও তার ভূত আমাদের পিছু ছাড়ছে না। গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক পরিচালক তার কর্মস্থলে যোগ দিয়েই নিদের্শনা জারি করলেন, 'এখন থেকে পুরুষদের পোশাকের দৈর্ঘ্য হবে টাকলুর উপর ও নারীদের হিজাব পরতে হবে।' বিপদ আঁচ করতে পেরে সরকার দ্রুত তাকে প্রত্যাহার করেছিল। অনেকের উপরেই ওই ভূত ভর করে আছে এখনও। বরিশালের ঘটনা তাই সাক্ষ্য দেয়।মেয়র-প্রশাসন দুপক্ষেরিএই মুখোমুখি অবস্থা ক্ষমতার দাপটের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
ক্ষমতার 'নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য' পাশাপাশি না চললে তা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশের এক অভিনেত্রীকে তৃতীয়বার পুলিশ হেফাজতে নিতে হয়েছে। ঐ অভিনেত্রীর বিরুদ্ধের অভিযোগ কী এতো জটিল যে একের পর এক পুলিশ হেফাজতে নিতে হচ্ছে? নাকি, তদন্ত পরিচালনায় পুলিশের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করে রির্পোট দিয়ে প্রশংসিত হতে দেখেছি পুলিশকে। এটা আসলে ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা। এদেশের জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রীর বাড়ি তল্লাশি ও গ্রেফতারে কোর্টের কোন পরোয়ানার প্রয়োজন হয়নি। পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার ও বাড়ি তল্লাশি সম্ভব হয়েছে। এই ঘটনা থেকে সাধারণ মানুষের অবস্থা সহজে অনুমান করা যায়। এই 'ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতায়' মানুষ অসহায় ও বিপন্ন বোধ করে।
১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ প্রথম দশকেই অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। এই অভিজ্ঞতা তৃতীয় বিশ্বের আরো অনেক দেশের। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলোর 'ব্যর্থতাকে' দায়ী করে থাকে। ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি হতে আমাদের দেশে সামরিক শাসনের অবসান হয়েছে। দুই যুগের এই বেসামরিক শাসন আমলে কোথাও কোথাও সরকার, সরকারি দল ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র অনেকটা মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখা যায়। এই ধরনের প্রবণতার পরিণতি অত্যান্ত ভয়াবহ। গত ২০ বছরে বাংলাদেশের সাফল্যে পৃথিবীর বহুদেশ বিস্মিত।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের উন্নয়নের উদাহরণ দেন সবসময়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আইন শৃংখলার উন্নয়ন বিশেষকরে ধর্মীয় সন্ত্রাস নির্মূলে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে প্রশংসিত। উন্নয়ন ও সাফেল্যের এই ধারা অব্যাহত রাখা ও স্থায়ীত্বশীল রূপ দিতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে ভাবতে হবে। পুলিশি বলপ্রয়োগের মাধমের সাফল্য সাময়িক। দেশে যদি অবাধ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা না থাকে তাহলে অনেক রাজনৈতিক অপশক্তির বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশে এই লক্ষণ খুবই স্পষ্ট।
প্রতিটি মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন। সে তার মতো করেই নিজের মত প্রকাশ ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। অন্যোয়ের প্রতিবাদ একা করতে না পারলে সে সমমনাদের নিয়ে সংগঠিত হবে। সংগঠন করবে বা রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রতিবাদটা জারি রাখবে। এটা প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের অংশ। এটাতে কেউ হাত দিতে চাইলে রাষ্ট্র সেটা প্রতিহত করবে এবং নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করবে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এর বিনিময়ে নাগরিক রাষ্ট্রের আইন ও বিধি নিষেধ মেনে চলবে এবং রাষ্ট্রকে কর প্রদান করবে। এ রকম একটি চুক্তির মাধ্যমেই একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বা হওয়ার কথা। কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের আস্ফোলন, হুমকি এবং মিছিল নিয়ে আসিফ নজরুলের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিতে দেখেছি। ছাত্রনেতাদের বক্তৃতা ও শারীরিক ভাষা ভীতিকর। এরাই কি আগামীদিনে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিবে? এ রকম ঘটনা একটি বা দুটি নয় বরং হাজারটা।
"তোমার কথার সাথে আমি একমত নাও হতে পারি কিন্ত তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য আমি জীবন দিতে পারি" এ রকম অমোঘ বাণী নিয়ে কোন নেতা এগিয়ে আসেন না বরং উল্টোটা, যেন ছাত্র নেতাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়। এভাবেই সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটে।
ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার সাম্প্রতিক আরো বহু ঘটনা সরকারে সাফল্য ও নৈতিক অবস্থানকে ম্লান করছে। ক্ষমতাসীন দলের বহু নেতার 'দাপিয়ে' বেড়ানোর প্রবণতা প্রকট। অনেক নেতা নেত্রীর কেলেংকারি জনসম্মুখে এসেছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি ঘটেছে তা বলা যাবে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারকেও একই রকম বিব্রত হতে দেখেছি। যুদ্ধোত্তর দেশে মানুষের দারিদ্র্য ও সংকট তীব্র হওয়া সত্বেও মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও দেশপ্রেম এখনকার চেয়ে বেশি ছিল।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের এক বিখ্যাত উক্তি, "গণতন্ত্র হল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম"। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মুখ বন্ধ করলে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা তার চেতনা জারি রাখতে হয়। ক্ষমতাসীনরা যুগে যুগে এই সহজ বিজ্ঞানটা ভুলে যান। জনগনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন তারা ভয়ের চোখে দেখে। ফলে কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে না। মানুষ নালিশ জানানোর কোন জায়গা খুঁজে পায় না। আইনের শাসনের কোন ব্যত্যয় ঘটলে আইনী প্রতিষ্ঠানগুলোর নড়েচড়ে বসার কথা তা আমাদের দেশ ঘটে না।