অর্থ, সুখ এবং আপদকালীন সংকট ব্যবস্থাপনা
উন্নতির সঙ্গে সুখের একটা সমান্তরাল, মুখোমুখি ও বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। কথাটা একটু জটিল এবং বিতর্কিত মনে হতে পারে; কিন্তু অসত্য নয়। আর্থিক উন্নতি হলে কোনো ব্যক্তির জীবনে সুখের প্রাচুর্য থাকে, কারও অভাব ঘটে, সুখের সঙ্গে কেউ পাশাপাশি চলে, কিন্তু সুখ অধরা থাকে; আবার কেউ সুখের খোঁজে অন্তঃপ্রাণ থেকে দুঃখের মধ্যেই বসবাস করে।
যে ব্যক্তি অভাবে ছিল, আর্থিক অনটনে ছিল, তার তো আর্থিক উন্নতি সুখের উপস্থিতি নিয়ে আসার কথা; কিন্তু কেমন করে সেটির অভাব ঘটে তাহলে? সুখ একটি নান্দনিক অনুভব। মন ও মননে যে অনুভব মানুষকে আন্দোলিত করে, শিহরিত করে, বিচিত্র স্বপ্নে অবগাহন করতে শেখায়। আর দুঃখ ঠিক তার বিপরীত। সুখ-দুঃখ দুটোই আবেগ থেকে উত্থিত।
অন্যদিকে, আর্থিক উন্নতি মানে বস্তুগত উন্নতি, সম্পদের বৃদ্ধি। মানসিক সুন্দর সুখানুভূতি ও আর্থিক উন্নতির সম্মিলন মাঝে মধ্যে খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আর কঠিন হয়ে পড়ার কারণ হতে পারে বিষয়টি ব্যবস্থাপনার দিকে নজর না দেওয়া।
অবশ্য, টাকা বা সম্পদের অব্যবস্থাপনার কারণে মাঝে মধ্যেই মানসিক অনুভূতিতে নান্দনিকতার অনুপস্থিতি ঘটতে পারে অনেকের। তাই দেখা যায়, অনেক সময় অনেক আর্থিক উন্নতির পরেও মানুষ সুখের আচ্ছাদন থেকে বের হয়ে আসছে। মানুষ ভুলে যাচ্ছে সুখের সুন্দর অনুভূতির কথা।
এক ভদ্রলোককে চিনি, যিনি খুব সুখে ছিলেন যখন তার অল্প টাকা ছিল। কিন্তু অনেক টাকার মালিক হওয়ার পর সারাক্ষণ এই চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকতেন- এই বুঝি তার টাকা-পয়সা সব হাতছাড়া হয়ে গেল; এই বুঝি তিনি নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেলেন। এই ভয় তাকে অসুস্থ করে ফেলেছিল; তার সমস্ত সুখ নষ্ট করে ফেলেছিল।
করোনাভাইরাস মহামারি দুই-তিন মাস আমাদের ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। আমাদের মধ্যে যারা খুব কর্মপ্রিয়, তারা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছেন। অনেকে খুব বাজে জীবনযাপন করছেন। তবে অধিকাংশ মানুষ যে সমস্যার সম্মুখীন, তা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। মানে, মানুষের যেহেতু কাজ নেই, তাই হাতে টাকা নেই। মানে, তাদের ক্রয় ক্ষমতা নেই। সেজন্য মনে দুশ্চিন্তা আছে; সুখ নেই।
এখন একটি প্রশ্ন আপনাকে করতে চাই। আপনি এতকাল আয় করেছেন- কেউ ৫ বছর, কেউ ১০ বছর, কেউ-বা ৪০ বছর। তিন মাস কাজ নেই বলে হাতে কিছু নেই; শূন্য হয়ে গেছেন। কেন? একবারও প্রশ্ন জেগেছে মনে? উত্তর খুঁজে দেখুন।
আসলে আমরা কেউ খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকি না। আর সেজন্য খারাপ সময় এলে যে আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়তে পারি, তা মনেই হয় না। আমরা মনের অজান্তেই ধারণা পোষণ করি, আমার জন্য খারাপ সময় আসবে না। আর সেজন্য খারাপ সময়ে কেমন করে সামাল দেব, সেই চিন্তাও মাথায় আসে না। মনের শান্ত অবস্থা অবিচল থাকে।
তারপর যখন খারাপ সময়টা আসে, তখন মুষড়ে পড়ি; ভাবি, বিপদটা যদি কোনোভাবে পার হতে পারি, তাহলে এরপর থেকে সব সতর্কতা অবলম্বন করব। কিন্তু পরবর্তীকালে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কাই থাকে। আর্থিক অবনতি হলেও সুখের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
সুখের সঙ্গে টাকার কোনো আন্তঃসম্পর্ক আছে নাকি নেই? আছে। টাকা বেশি থাকলে আপনি উদ্ভ্রান্ত থাকেন, টাকার অব্যবস্থপনা আপনাকে পেয়ে বসে; আবার টাকা না থাকলে অভাব আপনাকে পেয়ে বসে। শাখের করাতের মতো টাকার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি আপনাকে কাটতে থাকে। আপনি বড়ই বিপদগ্রস্ত, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
তাহলে আপনার করণীয় কী? আপনার করণীয় হচ্ছে টাকার ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়া। আর বুঝতে শেখা, আপনি যত টাকা আয় করুন না কেন, যদি সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে না পারেন, তাহলে সেই টাকা ধরে রাখতে পারবেন না। তাছাড়া টাকা বা সম্পদের শক্তিকে বুঝতে না পারলে সেই আগুন আপনাকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, সুখ বাস করে মনের গহীনে। টাকার সঙ্গে সুখের সম্পর্ক আছে; কিন্তু তারচেয়ে বড় সম্পর্ক হচ্ছে টাকার বা সম্পদের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আপনার মনের, হৃদয়ের।
এবার ধরা যাক কোয়ারেন্টিন সময়ের কথা। আমরা প্রায় সবাই বাসায় আছি। এই সময় পবিবারের সবার সঙ্গে খুব আন্তরিক সম্পর্ক বজায় থাকার কথা। আপনি পরিবারকে সময় দিচ্ছেন, কাজে সাহায্য করছেন, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খবর নিচ্ছেন, সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছেন। কি দারুণ ব্যাপার! সবাই কত সুখে থাকার কথা; কিন্তু খুব অল্পজনে সুখে আছেন। কেন?
কারণ, এই নিবিড় ও যত্নবান অবস্থান ভালো লাগছে না। অনেকের কাছে টাকা নেই, আয় নেই; তাই শান্তি উধাও। আবার একসঙ্গে বেশিক্ষণ, বেশিদিন থাকতে থাকতে বিরক্তি উপস্থিত, শান্তি অনুপস্থিত। এখানেও মূলত একই অবস্থা- ব্যবস্থাপনার সদিচ্ছা ও দক্ষতার অভাব; আবার শান্ত হয়ে, ধৈর্য ধরে ব্যবস্থাপনা করার মনোযোগের অভাব। সেজন্য অশান্তি; সুখ নষ্ট।
টাকা, সম্পদ, সম্পর্ক, সুখ এবং যত ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আবেগ- সবকিছু একটা অপ্টিমাম লেভেলে নেওয়ার জন্য যেটা দরকার, সেটা হলো ভালোভাবে ম্যানেজ করার জন্য যত্নবান হওয়া, ম্যানেজ করতে পারা। যারা সেটা পারে, তারা সুখী হয়; যারা পারে না, তারা সুখের খোঁজে থাকে সারাক্ষণ : সুখ এই ধরা দেয় তো এই পালিয়ে যায়!
দুই.
এবার একটা গল্প বলি। একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সম্পদ অর্জনের গোপনসূত্র নিয়ে আলোচনা করার জন্য।সঙ্গে আমার স্ত্রীও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আমি সেখানে আমার মূল আলোচনার সঙ্গে সুখের বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। লোকজন দারুণ আলোড়িত হন। তারপর কর্তৃপক্ষ আমার স্ত্রীকে অনুরোধ করেন কিছু বলার জন্য। তিনি কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই সেখানে গিয়েছেন। তারপরও কিছু বলতে দাঁড়ান। আমি তখন সামনের দর্শকসারির প্রথম দিকে বসেছি। তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলা শুরু করছেন। হঠাৎ এক বয়স্ক শ্রোতা, সম্ভবত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন, দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীকে একটা প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটি ছিল, আপনার স্বামী কি আপনাকে সুখি করতে পেরেছেন?
প্রশ্ন শুনে আমার স্ত্রী মৃদু হাসলেন। হাসির উত্তর কী- বোঝা গেল না। 'হ্যাঁ' হতে পারে, আবার 'না'ও। আমি একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম! ভাবলাম, যদি উত্তরে তিনি 'হ্যাঁ' বলেন, তাহলে তো আমি বাঁচলাম; কিন্তু যদি 'না' বলেন, তখন? আমি আমার কাছাকাছি বের হওয়ার দরজাটা দেখে রাখলাম, যেন পরিস্থিতি সেরকম হলে দ্রুত কেটে পড়তে পারি! আমার স্ত্রী উত্তর শুরু করলেন।
'আমি খুব খুশি হয়েছি এমন একটা প্রশ্ন করার জন্য। আমার স্বামী একটু আগে কথা বলে গেলেন। আসলে তিনিই এখানে আজ আমন্ত্রিত বক্তা, আমি শ্রোতা হিসেবে এসেছি। আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। আমার স্বামী আমার দেখা ভালো মানুষদের অন্যতম। তিনি তার জীবনের বড় যেসব সিদ্ধান্ত, আমার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই নেন। আর্থিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই আমার সঙ্গে পরামর্শ করেন। আমি যখন যা চাই, তার সামর্থ্য থাকলে তিনি না করেন না, যদি আমার চাওয়াটা যৌক্তিক হয়। তাছাড়া আমরা দুজন পৃথিবীর অর্ধেকটা চষে বেড়িয়েছি।'
আমার খুব ভাল লাগছিল। তার কথার মধ্যে আমার জন্য কোনো দুঃসংবাদ তখনো ছিল না। আমি স্বস্তিবোধ করছিলাম। মুখে আমার হাসি লেগেই ছিল।
তিনি বলে চললেন, 'দেখুন, আমরা দুজন মান-অভিমান করেছি; নিজেরা আলোচনা করে আবার সেটা মিটিয়েছি। কিন্তু...!'
কথার এ পর্যায়ে একটু থামলেন আমার স্ত্রী। শ্রোতারা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমার অপেক্ষা তো আরও কয়েকগুণ বেশি। তিনি 'কিন্তু' বলে চুপ কেন?
'কিন্তু...'! শ্রোতাদের মধ্যে থেকে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এই বুঝি আমার স্ত্রী আমার সম্পর্কে, নিজের সুখ সম্পর্কে এমন কিছু বলবেন- যা কেউ আশা করেনি।
তিনি মুখ খুললেন, 'কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সুখি করতে পারেন না!'
শত জোড়া চোখ তখন আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মনে হলো, এই কথা শোনার জন্য কি জীবনের এতটা বছর একসঙ্গে থাকা? এই কথা শোনার আগে কেন আমার মরণ হলো না!
শ্রোতারা তার কাছে ব্যাখ্যা দাবি করলেন। তিনি আবার মৃদু হাসলেন। আমার অসহায় চেহারার দিকে তাকালেন। তারপর বলা শুরু করলেন।
'আমার স্বামী আমাকে সুখি করতে পারেন না; কারণ সুখি করা তার কাজ নয়। সুখি হওয়াটা আমার কাজ। আমার স্বামী আমার জীবনকে যতই সাজাতে চান না কেন, আমি যদি নিজের মন সাজাতে না পারি, নিজে যদি সুখবোধ না করি, কার সাধ্য আমাকে সুখি করে? সবচেয়ে বড় কথা, আপনাদের সবার সামনে কথাটা পরিষ্কার করা জরুরি। আর তা হলো, আমি খুবই সুখি একজন মানুষ। বোধ করি, আমার স্বামীও খুব সুখি। আমরা দুজনেই জানি, কীভাবে সুখী হতে হয়।' (এটি লেখকের জীবন থেকে নেওয়া নয়!)
ওপরের আলোচনা এবং নিচের গল্প থেকে বোধ করি একটি বিষয় নিয়ে ভাবার আছে। সুখি হওয়ার দায়িত্ব আপনার নিজের। সেজন্য আপনার প্রস্তুতি থাকতে হবে, যেন কেউ আপনার সুখ কেড়ে নিতে না পারে। নিজের টাকা বা সম্পদের ব্যবস্থাপনা করা আপনাকে শিখতে হবে, করতে হবে, জানতে হবে। সম্পদ বা টাকা ব্যবস্থাপনা করতে পারা এক ধরনের দক্ষতা। এই দক্ষতা অর্জন করতে হলে চাই গভীর মনোযোগ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। শুধু আয় করলে হবে না; সংকটকালের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। আপদকালীন টাকা, বিশেষ করে ৩ মাস থেকে ৬ মাসের পরিচালন ব্যয় রাখা দরকার। সেটা পরিবারের হোক বা প্রতিষ্ঠানের।
আর্থিক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আপদকালীন সংকট ব্যবস্থাপনার জন্য যদি সরকারের দ্বারস্থ হতে হয়, তাহলে আমাদের কিছু ভাবনার আছে কি না, প্রস্তুতির বিষয় আছে কি না- ভেবে দেখতে হবে। সমস্যা যদি লম্বা সময় ধরে চলে, সেখানে রাষ্ট্রের সহায়তা লাগবে। বিপদে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, সেটা আমরা অবশ্যই প্রত্যাশা করব। কিন্তু আমরা এটাও ভাবব, আমাদের কোনো ত্রুটি বা অপ্রস্তুতি আছে কি না- যেটা ভবিষ্যতে আর থাকবে না।
আমরা কি সামনের বিপদে সুখে রাখতে পারব নিজেদেরকে- ঘরে, বাইরে। আপদকালীন টাকা কি থাকবে আমাদের হাতে!
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল