আমরা কি চিকিৎসকদের ভয়াবহ বিপদে ঠেলে দিচ্ছি?
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যেখানে ইতোমধ্যেই উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যখাতকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, সেই মারাত্মক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সম্মুখসারির যোদ্ধা- চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের লড়তে হচ্ছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ঘাটতি নিয়েই। সাম্প্রতিক এক জরিপে এই ভীতিকর পরিস্থিতি প্রকাশ পেয়েছে।
শনিবার প্রকাশিত হওয়া সেই জরিপে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও নার্সদের শতকরা ২৫ ভাগ এবং চিকিৎসা সহায়তাকর্মীদের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ এখনো ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) পাননি। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, যারা এই সরঞ্জাম পেয়েছেন, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে; কেননা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের বিচারে এগুলো নিম্নমানের।
তাদের এই উদ্বেগ গুরুতর। এটিকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া ও গোপন করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে বাস্তবতা সম্পর্কে তারা অবগত। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে ইতোমধ্যেই অন্তত ১৭০ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। এছাড়া, আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০০ নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসাকর্মী। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মুখসারির অনেক যোদ্ধাই রয়েছেন ঝুঁকিতে।
এই ভাইরাসের বৃহৎ পরিসরের সংক্রমণের পর যুক্তরাজ্য ও স্পেনের মতো অগ্রসর দেশগুলোর স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিকূল লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বিশ্ব গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা ইতোমধ্যেই জানি। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে হাজারও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, এবং তাদের মধ্যে কয়েক শতজন হারিয়েছেন প্রাণ। তাই আমাদের দেশেও যদি ভাইরাসটির এমন বৃহৎ পরিসরে সংক্রমণ ঘটে, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ভাগ্যে কী ঘটবে- সে নিয়ে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
২১ মার্চ ব্লুমবার্গে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্পেনের কিছু হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা তাদের ডিসপোজেবল কোট ফুরিয়ে গেছে বলে, শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সময় নিজেদের রক্ষা করার জন্য হাতে গার্বেজ ব্যাগ বেঁধে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সরবরাহকৃত প্লাস্টিকের চশমাগুলো এতই নিম্নমানের, সেগুলো পরলে তারা বলতে গেলে চোখে কিছুই দেখতে পান না; ফলে নাড়ি দেখতে ও শিরা খুঁজতে করোনাভাইরাস রোগীদের হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয় তাদের।
জরুরি বিভাগগুলো রোগীতে সয়লাব হয়ে গেছে বলে নিজেদের হাত, পা ও মাথায় মেডিকেল বর্জ্যরে ব্যাগ পেঁচিয়ে সেবারত নার্সদের হৃদয়বিদারক ছবি মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যের পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়েছে।
বাধ্য হয়েই সুরক্ষা পোশাক হিসেবে বিন-ব্যাগ বা পলিথিনের বস্তা পরে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া তিন নার্সের ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে এপ্রিলের প্রথম দিকে।
স্পেন ও যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই রোগীতে সয়লাব হয়ে আছে; তবে গুরুতর ব্যাপার হলো, রোগীর সংখ্যা প্রতি মুহূর্তেই হু-হু করে বেড়েই চলেছে। তাদের স্বাস্থ্যখাতকে এভাবে নাজেহাল করে দেবে, এমন একটি আচমকা প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না তারা।
প্রাদুর্ভাবকে রুখে দিতে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যেহেতু কিছুটা সময় পেয়েছে, তাই আমাদের পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়াই উচিত। কিন্তু অবহেলা ও তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সময় নষ্ট করেছে।
আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি বিবৃতিকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক।
এ বছরের ২৭ জানুয়ারি এক আন্ত-মন্ত্রণালয় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, বাংলাদেশে যেহেতু তখনো পর্যন্ত কোনো কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়নি, তাই এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। করোনাভাইরাস যখন চীনে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আঘাত হেনেছে, এমন সময়ে এমনতর আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।
মন্ত্রী বলেছিলেন, 'ভাইরাসটি যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।' আরও বলেছিলেন, 'ভাইরাসটি যদি আমাদের কাউকে আক্রান্ত করেও, সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।'
মন্ত্রীর সেই আশ্বাস যে স্রেফ কথার কথাই ছিল, সেটি প্রমাণ হতে খুব একটা সময় লাগেনি।
৮ মার্চ দেশে প্রথমবার করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর, রাজধানীর ভেতরের এবং ঢাকার বাইরের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষা সরঞ্জাম ঘাটতির কথা জোরালভাবে জানিয়েছিলেন। কিছুদিন পর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও, প্রস্তুতির ঘাটতির মর্মান্তিক সত্যটি ব্র্যাকের জরিপ স্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে।
আমাদের সম্মুখসারির যোদ্ধাদের জন্য লড়াইটি দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফেরা প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন সুনিশ্চিত করতে প্রশাসনের অবহেলা ও অদক্ষতা, রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বন্ধ করার ব্যাপারে আমাদের ব্যর্থতা এর কারণ; প্রবাসীরা যার যার বাড়ি চলে গেছেন, এর ফলে সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে- যার ফল এখন আমরা ভোগ করছি।
নতুন নতুন হটস্পট দেখতে পাচ্ছি আমরা- প্রথমে ঢাকা, তারপর নারায়ণগঞ্জ, তারপর একে একে গাজীপুর, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ। এখন তো দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে পঞ্চাশটিরও বেশি জেলায় শনাক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস রোগী।
তার মানে, আমাদের সম্মিলিত অবহেলা ও অদক্ষতা এই প্রাণঘাতী ভাইরাসকে প্রায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। ভাইরাসটির অনিয়ন্ত্রিত গতি মানুষের জীবনকে ফেলে দিয়েছে ঝুঁকিতে; তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর বোঝা দিন দিন আরও ভারি হয়ে যাচ্ছে।
ভীতিকর ব্যাপার হলো, আমাদের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা খুবই কম হওয়ায় আক্রান্তের প্রকৃত চিত্রটি আমরা জানি না। ফলে এ-ও জানি না- কারা ভাইরাসটি বহন করছেন আর কারা করছেন না। এমনকি, আক্রান্ত হওয়ার খবর গোপন করতেও শুরু করেছেন অনেকে।
দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত সপ্তাহে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার খবর গোপন করে, হৃদরোগ নিয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন এক রোগী। কর্তৃপক্ষ যখন জানতে পারলেন ওই রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন তারা একটি করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) বন্ধ করে দেন এবং ওই রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক ও নার্সদের পাঠিয়ে দেন কোয়ারেন্টিনে।
আরেকটি ঘটনায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ১১ জন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর কোভিড-১৯-এর টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে; কেননা, চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর আত্মীয়রা ওই রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থাকার খবর গোপন করেছিলেন।
এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাস আক্রান্তসহ অন্যান্য রোগীর সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরঞ্জামের ঘাটতিকে সামনে তুলে ধরে লড়াই থামিয়ে দেননি তারা।
যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলোতে একটি বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও, রোগীর সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য এখনো সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে সেখানে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যুক্তরাজ্য সরকার নিরন্তর সমালোচনার মুখে পড়ছে। ভাইরাসটিতে প্রাণ গেছে অনেক চিকিৎসাকর্মীর। চিকিৎসকরা সম্প্রতি তাদের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছেন, তাদেরকে 'নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলা হয়েছে', এবং কাজ চালিয়ে যাবেন, নাকি নিজেদের ও নিজ পরিবারকে সুরক্ষিত রাখবেন- এরমধ্যে কোনটা বেছে নেবেন, তাদের সে ব্যাপারে বাধ্য করা উচিত হবে না।
যুক্তরাজ্য সরকার মরিয়াভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের সম্মুখসারির যোদ্ধাদের কণ্ঠরোধ না করে বরং সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করার।
আমাদের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মনে রাখা উচিত, নিজেদের ও নিজ রোগীদের আক্রান্ত হওয়া থেকে এবং অন্যদের আক্রান্ত করা থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করতে হয়।
কর্তৃপক্ষের অবশ্যই আমাদের সম্মুখসারির যোদ্ধাদের কাছে সব ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা উচিত; আর সেটি কোনো ধরনের অজুহাত দিয়েই কিংবা গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাদের কণ্ঠরোধ করার কোনো রকম প্রচেষ্টা না করেই।
এই ঘোরতর পরিস্থিতিতে আমরা তাদের নেকড়ের সামনে ছুড়ে দিতে পারি না। তাদের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম দিতে হবেই। তারা হেরে গেলে আমরাও হেরে যাব খুব বাজেভাবে।
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
মূল লেখা: Are we putting our doctors in great danger?