আমাদের, পূর্ব বাংলার মহাশ্বেতা
বাংলা সাহিত্যের নিরিখে উপমহাদেশের ইতিহাসের পাতায় যাদের নাম অঙ্কিত আছে, মহাশ্বেতা দেবী তাদের মধ্যে অন্যতম। বঙ্গভঙ্গের কারণে যে পূর্ববঙ্গের জন্ম হয়েছিল, তারই রাজধানী ঢাকার আরমানিটোলায় এক নারীর জন্ম, যার পিতা নাম রেখেছিলেন মহাশ্বেতা। সময়কাল ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি।
শৈশব কেটেছে পাবনা জেলার বেড়া উপজেলাধীন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের রাকসা তারানগর গ্রামে। মহাশ্বেতার পরিবারের অনেক সদস্য পূথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভেতর থেকে সৃষ্টি ভারত-পাকিস্তানের জন্ম বছর, ১৯৪৭ সালে নিজ জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তার বয়স তখন মাত্র ২১ বছর। উল্লেখ্য, এর আগে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঢাকা, নোয়াখালীসহ পূর্ববঙ্গের এ অংশেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
মহাশ্বেতা দেবীর পিতা মণীশ ঘটক ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের বড় ভাই। ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই ৯০ বছর বয়সে কলকাতা শহরে এই মহিয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।
পিতা মণীশ ঘটক ছিলেন সাহিত্য আন্দোলনে জড়িত। তার মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। মহাশ্বেতা দেবীর অন্য ভাইদের মধ্যে সংকু চৌধুরী ছিলেন ভাস্কর শিল্পী, শচীন চৌধুরী ছিলেন দ্য ইকোনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অব ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। প্রখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেছিলেন মহাশ্বেতা।
বাংলাদেশের বর্তমান সংসদের নারী সাংসদ আরমা দত্ত মহাশ্বেতার আপন ফুপাত বোন।
মহশ্বেতা দেবীর জীবনে এই পারিবারিক প্রভাব সাহিত্যকর্মের দিকে মনোযোগী করে তোলে। ১৯৪৭ সালের পরে পশ্চিমবাংলায় তার ছাত্রজীবন শুরু হয় রবি ঠাকুরের শান্তি নিকেতনে। ১৯৫৪ সাল থেকে মহশ্বেতা দেবীর সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। পশ্চিম ও পূর্ববাংলার নারী সাহিত্যকর্মী হিসেবে সকলের মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসেবে জায়গা করে নেন তিনি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের করুণ পরিণতিতে এই মহিয়সী নারীকে আমরা আজ আমার দেশের নারী হিসেবে দাবি করতে পারি না। ভারতীয় অংশে জন্ম না নিয়েও বিশ্বের কাছে আজ তার পরিচয় ভারতীয় সাহিত্যিক হিসেবে।
১৯৬০ ও '৭০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে চলমান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়ে তার সাহিত্যকর্মে। একাধিক উপন্যাসের এই রচয়িতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় 'হাজার চুরাশির মা'। এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু- বিহার, পশ্চিমবাংলাসহ ভারতের নানা অংশে সেই সময় ছড়িয়ে পড়া নকশাল বাড়ি আন্দোলন।
পরবর্তী সময়ে 'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাস অবলম্বনে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
লেখালেখির পাশাপাশি এই বামপন্থী লেখিকা আদিবাসীদের সমাজ উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। বিশেষ করে লোদা ও সবর নামে দুই গোষ্ঠীর জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের এই ছাত্রী ঝাঁসির রানী লক্ষীবাইকে নিয়ে তার প্রথম লেখা সকলের নজরে আসে। তারপর তার অন্যতম লেখা- 'অরণ্যের অধিকার', 'অগ্নিগর্ভ' ছাড়া আরও অনেক উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গল্প প্রকাশিত হয়।
মহশ্বেতা দেবীর সাহিত্যকর্ম নোবেল প্রাপ্তির জন্য কখনো মনোনীত না হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পদ্মবিভূষণ ও পদ্মশ্রী- যা যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এছাড়াও র্যামন ম্যাগসেসে, সার্ক লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড, জ্ঞানপিঠ সাহিত্য একাডেমি ও সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম।
পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির প্রয়াণ দিবস আজ। গণমাধ্যমের নানান অংশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এই মহিয়সী নারীর প্রয়াণ দিবসের কোনো সংবাদ লক্ষ করিনি। বাঙালি হিসেবে এটা বড়ই কষ্টের।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক