জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ ও খাদ্য নিরাপত্তা: একটি নেক্সাস পর্যবেক্ষণ
বিজ্ঞানীরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হবে বনাঞ্চল ও জীব বৈচিত্র্যের বিনাশ, জলবায়ুর বিশৃঙ্খলা (chaos) এবং বৈশ্বিক মহামারি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এর একটি সর্বাধুনিক উদাহারণ। এই ভাইরাস সংক্রমণের একটি বিশেষ মর্মার্থ হলো, এটি প্লানেটারি ইমারজেন্সির প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরতে পেরেছে।
কোভিড-১৯ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষ, সমাজ ও সরকার ব্যবস্থা 'প্রকৃতির রূঢ় আচরণের' কাছে কতটুকু অরক্ষিত (vulnerable) এবং অসহায়, যার জন্য জলবায়ুর প্রতি মানুষের উদাসিনতা অনেকটাই দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃষি গভীরভাবে পরস্পর সংযুক্ত। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা- দুটোই সাদৃশ্যপূর্ণ। করোনাভাইরাস মহামারির আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯, এবং খাদ্য নিরাপত্তার যোগসূত্রের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলোর মূল্যায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কোভিড-১৯-এর সম্পর্ক
জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ (যেমন, বনাঞ্চল ধ্বংস) মহামারি রোগ বা ব্যাধির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের মূল কারণ মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ক্ষতিকর মিথষ্ক্রিয়া।
গবেষণা দেখাচ্ছে: বানর জাতীয় প্রাণী থেকে এইচআইভি ভাইরাস, পাখি থেকে এভিয়ান ফ্লু, শূকরের দেহ থেকে সোয়াইন ফ্লু, বাদুড় থেকে সার্স ও ইবোলা ভাইরাস, এবং সাম্প্রতিককালে, 'বাদুড় থেকে করোনাভাইরাসের সৃষ্টি হয়েছে' বলে অনেকেই ধারণা করেছেন। মোদ্দা-কথা, মানুষ সব সময়ই, প্রাণীর দেহ থেকে আসা নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
রোগ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত। এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, মাত্রাতিরিক্ত হারে প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ। এই শোষণের ফলে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই প্রাণীরা (যেমন, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, শিয়াল, পাখি ও বানর) মানুষের কাছাকাছি আসছে এবং রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
বিপরীতে, কোভিড-১৯ লকডাউন অনিচ্ছাকৃতভাবে জলবায়ুর উপকার বয়ে এনেছে। যেমন, এই লকডাউনে বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই কমেছে।
আবার, করোনা মহামারির কারণে 'জলবায়ু কূটনীতি' মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত। কপ-২৬-এর অনুষ্ঠান সময়মতো করতে না পারা বিশ্ব জলবায়ু কূটনীতির একটি উল্লেখ্যযোগ্য ক্ষতি।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক
কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বড় একটা ফ্যাক্টর। পৃথিবীতে কৃষি সেক্টর ২১ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের জন্য দায়ী। ক্লাইমেট ওয়াচের তথ্যমতে, যেসব দেশে কৃষিই গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের মূল উৎস, সেরকম ২৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের সারিতে।
কৃষিতে জমির ব্যবহার পরিবর্তন (land use change) গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের জন্য প্রধান উৎস। তবে কৃষি সেক্টর (বিশেষকরে ফরেস্টি) গাছ, বায়োমাস ও মাটিতে কার্বন সংরক্ষণের বিশাল ক্ষমতা আছে।
কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা জলবায়ু পরিবর্তনে (যেমন খরা, বন্যা ও সাইক্লোন) খুবই অরক্ষিত। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের জন্য জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ ক্ষতি হয়।
খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো শস্যের ফলন কমে যাওয়া, পোকা ও রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য নিরাপত্তার ৪টি ডাইমেনশানকেই ঋণাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
অভিযোজনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। দুটো প্রধান ব্যবস্থা: (ক) চাষিদের জলবায়ুর ঝুঁকি নিয়ে বাস করা শিখতে হবে। এজন্য তাদের দরকার সহজলভ্য ও কার্যকর তথ্য এবং জলবায়ুর ঝুঁকি বীমা। এবং (খ) চাষিদের ও কৃষির রেসিলিয়েন্সি শক্তিশালী করা, যেমন তাদের দক্ষতা বাড়ানো ও ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তি গ্রহণ।
কোভিড-১৯ মহামারির সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক
দেশব্যাপী লকডাউনের রক্ষামূলক ব্যবস্থার কারণে কৃষি উৎপাদন, খাদ্যের চাহিদা ও সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত। মৎস্য ও দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে কাঁকড়া, চিংড়ি ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন। এদেশে উৎপাদিত কাঁকড়া ৭০ শতাংশ রপ্তানি যায় চীনে, কিন্তু রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার জন্য এই সেক্টর আজ ধসের মুখে।
ছোট ও বড় সব কৃষকই কোভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত; কারণ তারা এগ্রিকালচারাল ইনপুট সংগ্রহ, ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহণ, ও বাজারজাতকরণে নানা রকম বাধার সম্মুখীন।
প্যানিক-বায়িং খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। কোভিড-১৯ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের অনেক পণ্য উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেসব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসছে।
কোভিড-১৯ খাদ্যের চাহিদাকে প্রভাবিত করেছে। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় এবং তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করায়, অনেকেই কম খরচ করছে; ফলে বিক্রির চাহিদা কমে গেছে। এতে উৎপাদনও প্রভাবিত। খাদ্যের চাহিদা মানুষের আয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গরিব মানুষের আয় না থাকায় তাদের খাদ্য গ্রহণ কমে গেছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে সমুন্নত রাখতে দরকার দৃঢ় পদক্ষেপ। যেমন, অভাবীদের খাদ্যের চাহিদা মেটানো, সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো, এবং পণ্য সরবরাহের বাধা দূর করা।
নেক্সাস পর্যবেক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কোভিড-১৯ ও খাদ্য অনিরাপত্তার তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কগুলো নির্দেশ করে- জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হলে, খাদ্য অনিরাপত্তা এবং (করোনা বা অন্যান্য) ভাইরাসের ট্রান্সমিশন বাড়তে পারে।
কোভিড-১৯ কৃষিতে, খাদ্য নিরাপত্তায়, অর্থনীতিতে ও জলবায়ু কূটনীতিতে বড় রকমের তাৎপর্য বয়ে এনেছে। এই সংক্রমণ দেখাচ্ছে, সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার কার্যকরী বাস্তবায়ন মহামারি মোকাবেলায় অত্যাবশ্যক।
একইসঙ্গে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে অ্যাড্রেস করতে ব্যক্তিগত, সামাজিক, অঞ্চলভিত্তিক, এবং জাতীয় উদ্যোগ অত্যাবশ্যক, যা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও তা ধরে রাখতে সাহায্য করবে। অনেক পদক্ষেপ (যেমন অর্গানিক, ক্লাইমেট-স্মার্ট বা এগ্রোইকোলজিক্যাল কৃষিকাজ প্রর্বতন) যেমন খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ায়, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রলম্বিত করে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারি খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কোভিড-১৯-এর টিকা হয়তো আজ না হয় কাল আসবেই, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচানোর টিকা নেই। তাই 'জলবায়ু পরিবর্তন' বিষয়টিকে সকল উন্নয়নের এবং কোভিড-১৯-এর রেসপন্স ও রিকোভারির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।
জলবায়ু-সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন বা বৃহৎভাবে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নই হতে পারে স্বাস্থ্য, জলবায়ু ও প্লানেটারি ইমারজেন্সির একমাত্র সমাধান।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও জলবায়ু পরিবর্তন কমানোই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ ও খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার অন্যতম প্রধান নির্ধারক। বর্তমানে 'গ্রিন কোভিড-১৯ রিকোভারি'কে জলবায়ু পরিবর্তন রক্ষার্থে টিকা হিসাবে ধরা যেতে পারে। তবে সেই রিকোভারিকে অবশ্যই প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট এবং টেকসই উন্নয়নের মূলনীতিকে অ্যাড্রেস করতে হবে।
- লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা