ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্পে ঢাকা পড়ে রইলো শান্তি, অগ্রগতি ও প্রগতি
৩রা মার্চ ১৯৮৮ সাল। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শাসনামল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান রাজনৈতিক দল বর্জন করে সেই নির্বাচন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করে, তারা ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৫১টি আসন লাভ করে। দেশের পার্লামেন্টে তখন বিরোধী দলের নেতা ৭৬টি রাজনৈতিক দলের মোর্চার আসম আব্দুর রব। ১৯৬৯ সালের ছাত্র গনআন্দেলনের নেতা। ১৯৭২ সালে জাসদ গঠনের অন্যতম রূপকার। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে সংসদে বিরোধী দলে অবস্থান নেয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করলে এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আসম আব্দুর রবকে দিয়ে ৭৬টি ছোটখাটো রাজনৈতিক দল নিয়ে 'সম্মিলিত বিরোধী দল' নামক মোর্চা গঠন করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একটি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ববিহীন পার্লামেন্ট গঠন করে। যে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ। এরশাদের সেই গৃহপালিত পার্লামেন্টে পাস করা হয় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী। সেই সংশোধনীর প্রধান ৪টি অংশ ছিল;
১. দেশের ছয়টি বিভাগে ছয়টি হাইকের্টের স্থায়ী বেঞ্চ গঠন করা। হাইকোর্ট বেঞ্চসমূহের এলাকা নির্ধারনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। (নবগঠিত স্থায়ী বেঞ্চ এরশাদ তার নিজ জেলা শহর রংপুরেও নিয়েছিলেন)
২. বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা
৩.ঢাকার ইংরেজি নামের বানান Dacca থেকে Dhaka রূপান্তর
৪. বাংলাদেশের কোন নাগরিকের বৈদেশিক খেতাব গ্রহণ করতে হলে পার্লামেন্টের অনুমতি নিতে হবে।
হাইকোর্টের অস্থায়ী বেঞ্চ গঠনের এখতিয়ার ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সেই ক্ষমতা প্রয়োগ আজও সুপ্রিম কোর্ট অনুধাবন করেনি। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে অস্থায়ী বেঞ্চ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন যতদুর মনে পড়ে। যদিও তা বাস্তবায়িত হয় নাই। ফলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত নিতে এদেশের মানুষকে ঢাকায় ছুটে আসতে হয়। এই অসুবিধার কারণে অনেককে ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হাইকোর্ট তাদের রাজ্যের দুরপ্রান্তের জেলা পশ্চিম দিনাজপুর ও তৎসংলগ্ন জেলাগুলোর জন্য পশ্চিম দিনাজপুরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন চ্যালেঞ্জ করা প্রথম মামলা, আনোয়ার হোসেন চৌধুরি বনাম বাংলাদেশ। সাল ১৯৮৯। প্রশ্ন উঠলো একক দেশে (unitary republic) একটার বেশি হাইকোর্ট থাকতে পারে কি না। অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশ নিয়ে গড়া দেশে (federal unitary) প্রতিটি প্রদেশে একটি করে হাইকোর্ট থাকে, যেমন ভারতে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য ছাড়া একটি একক দেশ, সেহেতু সেই দেশে একাধিক হাইকোর্ট কি সংবিধানসম্মত? হাইকোর্টের রায়ে সংশোধনীকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে বাতিল করা হয়। আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দিলেন, একক দেশে একাধিক হাইকোর্ট থাকতে পারে না, অতএব, সংশোধনীর একাধিক হাইকোর্ট বানানোর অংশটাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো।
অথচ অষ্টম সংশোধনীর অপর অংশ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অংশটুকু রেখে দেওয়া হলো। যে সংবিধানের মূল নীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষপতার কথা উল্লেখ আছে সেই সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ধর্ম দেয়া হলো, সেটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থী কিনা তা আইনের ছাত্ররা ভালো বলতে পারবেন।
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে বলা হয়, ''প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে৷'' পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হলেও, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এখনো বহাল আছে। তাই সেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের জন্যই এখন উচ্চ আদালতে একটি মামলা চলছে, যা দায়ের করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে৷ অর্থাৎ যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে সংযোজন করা হয়, সে বছরই।
'স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি'র পক্ষে দেশের ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক রিট আবেদন করেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে। আবেদনকারিদের মধ্যে ছিলেন, কবি সুফিয়া কামাল, বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, সিআর দত্ত প্রমূখ৷ তখনই আদালত রুল ইস্যু করে৷ এরপর ২০১১ সালে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলে আরেকটি সম্পূরক রিট হয় হাইকোর্টে এবং তাতেও রুল ইস্যু হয়৷ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রিট নিষ্পত্তির লক্ষ্যে তিন সদস্যে এক বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন।
হঠাৎ ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে বেঞ্চে রুলের ওপর শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত হয়। ২৮ মার্চ ২০১৭ মহামান্য আদালত রিটটি খারিজ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখেন। মামলাটি শুনানীর আগেরদিন হেফাজত ইসলামের পক্ষ থেকে সুপ্রিমকোর্টের সকল রীতি নীতি উপেক্ষা করে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে এবং তা গ্রহণ করা হয়।
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর হাত ধরে বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ্তার মৌলিক কাঠামো থেকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কাঠামোতে প্রবেশ করে। যদিও এর আগে সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বা ইসলামী ফাউন্ডেশনের মত ধর্মীয় কাঠামো গঠন করা হয়। যদিও ইসলামি রাষ্ট্রসমূহের সংস্থা OIC র সদস্যভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূল ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষ ত্যাগ করা শুরু হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের হুংঙ্কারে ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ফসল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক দুইটি হাজার মাইল দুরের ভূখন্ডের এক রাষ্ট্রের কাঠামোতে রূপান্তরিত হওয়া। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মাত্র একবছরে বুঝতে পেরেছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র তারা গঠন করেছে তার অবাঙ্গালী অংশ তাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। সেই ১৯৪৮ থেকে শুরু হওয়া সেই ভাষার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধীরে ধীরে ভৌগলিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি আমাদের ছয় দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয় ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয় ১৯৪৭ সালের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা। মুসলিম লীগ, জামায়েত ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে ব্যাপক গণহত্যায় লিপ্ত হয়।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের ব্যাপক গণহত্যায় লিপ্ত হতে আজও দেখা যায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তালেবান, আইসিস, আমাদের দেশের জামায়েত ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠি, এবং পাশের দেশ ভারতের ধর্মীয় জাতীয়বাদের নগ্ন উল্লম্ফনের কারণে ব্যাপক মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। কাশ্মীরের ধর্মতত্ত্ব ভারত পাকিস্তানের সকল যুদ্ধের উৎস। অযোধ্যার রামমন্দির বাবরি মসজিদ বিতর্কে রক্তাক্ত ধর্মীয় বিভাজন যার আপত পরিসমাপ্তি হয়েছে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রাম জন্মভূমির পক্ষে দেওয়া রায়ে। আজকের ভারতীয় রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত বিজেপির উত্থান সেই রাম জন্মভুমি ধর্মতত্বের জাতীয়তাবাদ। ভারতীয় সুৃপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি আসামের রঞ্জন গগৈই'র সময় আসামের NRC'র কারণে প্রায় সতের লক্ষ মানুষ তাদের শত বছরের পুরানো বাস্তুভিটা হারাচ্ছে এবং সেই রঞ্জন গগৈই'র নেতৃত্বের আদালত বাবরী মসজিদ বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে রামমন্দিরের পক্ষে দেয়া রায়ে। এই রায়ে ভারতীয় জনগণকে আরো বিভক্তির মধ্যে ফেললো কিনা তা ভবিষ্যত বলতে পারবে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের সেই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এখন বিজেপি'র রাজ্যসভার সদস্য।
এশিয়ার তিনটি ভূখণ্ড ফিলিস্তিন, মিয়ানমার ও কাশ্মীর। গত শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ধর্মীয় বিষবৃক্ষ রোপণ করে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর ও মিয়ানমারে। ধর্মতত্ত্ব ফিলিস্তিনে মুসলিম ও ইহুদীদের সংঘাত সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর ভয়ানক গণহত্যা, কাশ্মীরিদের অবরুদ্ধ জীবন এ সবই ঐ একই সুত্রে গাঁথা; ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যা কেবল মানুষকে বিভক্ত করেছে, করেছে হিংস্র ও রক্তাক্ত।
এক সময় ইউরোপের দেশগুলি ব্যাপকভাবে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের রোগে আক্রান্ত ছিল। বহু শতাব্দি বছর ধরে চলতে থাকা সেই সংঘর্ষ যে কতটা মানবতা বিরোধী তা ইউরোপের জনগণ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে চুড়ান্তভাবে অনুধাবন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, ফ্রান্সসহ ৬টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যাত্রা শুরু করে, সেখানে এখন ২৮টি দেশ। সামাজিক সাম্যতার লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন এবং সেই লক্ষ্যেই সকল সামাজিক আইন। দেশগুলির মধ্যে নানা বাণিজ্যিক সম্প্রসারনের মাধ্যমে পৃথিবীর জিডিপির ২২%। দেশগুলির সমাজে খৃস্টান ধর্মাবলম্বলী সংখ্যা বেশি। ধর্মের নানা বিভাজন, ক্যাথেলিক/ প্রোটেস্টান বিতর্ক ছিল ব্যাপক। ১৯৫১ সাল থেকে ইউরোপিয় ইউনিয়নের যাত্রার মধ্য দিয়ে আজ তারা সেই বিতর্কের অনেক ঊর্ধ্বে।
যে সামাজিক জাগরণ ইউরোপে ধর্মকে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে আলাদা করে ব্যক্তি পর্যায়ে নিতে পেরেছিল, সেই সামাজিক শক্তির উপর ভর করেই আজ তারা উন্নয়নের সকল সূচকের শিখরে অবস্থান করছে। ভারত তথা আমাদের এই অঞ্চলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্পে ঢাকা পড়ে রইলো শান্তি, অগ্রগতি ও প্রগতি।