পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম: চালুর পথে বাধা ও উত্তরণের উপায়
করোনা মহামারীর কারণে গত ২৪ মার্চ থেকে বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হয়। এর আগে, ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছেড়ে বাড়িতে চলে যায় ছাত্র-ছাত্রীরা।
এই পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য দূর থেকেই শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিটিভিতে চালু হয় 'ঘরে বসে শিখি' কার্যক্রম।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা বলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে অনলাইন ক্লাস নেয়া শুরু করে।
ইউজিসি একটি জরিপের মাধ্যমে জানালো যে, দেশের ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং অনলাইন ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতির হার ৭০%। হাতেগোনা দুয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন শাহজালালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ছাড়া অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেয়া সম্ভব নয় বলেও জানান তারা।
এই পরিস্থিতিতে যদি শিক্ষা কার্যক্রম সচল না করা যায়, তাহলে সেশন জটের একটা শঙ্কা কিন্তু থেকে যায়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট কমানোর বা দূরীকরণের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ভেবে থাকে যে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে সেশনজটসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করবে- তবে তা হবে একটা প্রতিক্রিয়াশীল এপ্রোচ।
দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে আট লাখ ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তা ভাগ্যের হাতে ঠেলে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কখন কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসবে তার জন্য।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করতে পারবে, পরীক্ষা দিতে পারবে, পরবর্তী সেমিস্টারে উন্নীত হতে পারবে, ভর্তি কার্যক্রম চালাতে পারবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সারা বিশ্বের সব দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনলাইনেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেই পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোো তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর জন্য তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
কিন্তু অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারছে না?
এর একটা বড় কারণ- এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ এসেছে গ্রাম ও মফস্বল থেকে। তাদের অধিকাংশের পরিবারই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। তাদের অনলাইনে ক্লাস করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাজেট (ল্যাপটপ, স্মার্টফোন) নেই, ইন্টারনেট কেনার সামর্থ্য নেই, আর দুর্বল ইন্টারনেট সিগন্যাল তো আছেই।
সমস্যা জটিল নিঃসন্দেহে, তাই বলে সমাধান কি নেই?
আছে। কিছুটা ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে পরিকল্পনামাফিক কাজ করলেই এর সমাধান করা সম্ভব।
সেই পরিকল্পনাটা কি হতে পারে?
ছোট ছোট বেশ কয়েকটি জরিপের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০% শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার মতো গ্যাজেট নেই, ডাটা কেনার সামর্থ্য নেই। সমাধান এদেরকে গ্যাজেট কিনে দিতে হবে, ডাটা কিনে দিতে হবে। দুটো বিকল্প আমাদের সামনে খোলা আছে।
প্রথমত, সোয়া চার লাখ শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন ক্রয় বাবদ ৪২৫ কোটি (স্মার্টফোন প্রতি দশ হাজার টাকা মূল্য ধরে) টাকা খরচ হবে। আর আগামী তিন মাসের (ছাত্রপ্রতি ৩ হাজার টাকা ধরে) মোবাইল ডাটা ক্রয় বাবদ খরচ হবে আরো ১২৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। সর্বমোট খরচ করতে হবে ৫৫২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। সারা দেশের সাড়ে আট লক্ষ শিক্ষার্থীর শিক্ষাবাবদ এই টাকা খুব বেশি নয়।
কিন্তু টাকাটা আসবে কোথা থেকে?
সরকার দেবে, না হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেশাজীবীদের জন্য প্রোগ্রামগুলো থেকে অর্জিত তহবিল থেকে এ ব্যয় নিজেরাই মেটাতে পারে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম থেকে প্রাপ্ত ৫০ কোটি টাকার তহবিল আছে, ওটা ব্যবহার করার সময় এখনই)।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথমবর্ষে ভর্তির ফরম বিক্রি করে প্রাপ্ত তহবিলও এ কাজে ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা (আ্যালামনাই)ও অর্থ যোগান দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং বিভাগীয় চেয়াররা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করবে এবং বিকাশ বা অন্যান্য মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের মোবাইল ফোনে টাকা পাঠাবে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ডাটা কেনার জন্য।
কোভিড-১৯ মহামারী খুব শীঘ্রই শেষ হবে বলে মনে হয় না। ঈদের পরে ক্লাস শুরু করতে চাইলে এখনি প্রস্তুতি শুরু করা দরকার।
শিক্ষকদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও লাগবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গুগলক্লাসে যোগ দিতে হবে। জুম আ্যপস ডাউনলোড করে একাউন্ট খুলতে হবে এবং এগুলোর ব্যবহার শিখতে হবে। এগুলো শেখা সহজ এবং এদের সার্ভিস বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।
ইন্টারনেটের গতি ও সিগন্যাল গ্রাম-অঞ্চলে দুর্বল। তারপরো জুম আ্যপসের মাধ্যমে ভিডিও অপশন বন্ধ করে সরাসরি ক্লাসে অংশগ্রহণ করলে ইন্টারনেটের ওপর চাপ কম পড়বে , খরচও কমবে।
তাছাড়া, শিক্ষকরা রেকর্ডকৃত লেকচার ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের ই-মেইল/গুগলক্লাসের মাধ্যমেো পাঠাতে পারে। লেকচার হ্যান্ডআউট ও অন্যান্য পড়ার সামগ্রী ক্লাস শুরুর আগেই গুগলক্লাস/ই-মেইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে শেয়ার করতে পারেন।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় বিকল্প পদ্ধতিটির আলোচনায়। এই পথটি খরচসাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদী হলেও সুবিধা অনেক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সোয়া ৪ লাখ শিক্ষার্থীকে স্বল্পসুদে (৫% সরল সুদে) ৫ বছরমেয়াদি ল্যাপটপ কেনার জন্য ঋণ সহায়তা দেবে সরকার। শিক্ষার্থীরা মাসে ৫০০ টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করবে এবং পাঁচ বছর ধরে এ ঋণ শোধ করবে। এ জন্য সুদসহ মোট খরচ হবে ১২৭৫ কোটি টাকা (ছাত্রপ্রতি ৩০ হাজার টাকা, ল্যাপটপের দাম ২৪ হাজার ও সুদ ৬ হাজার হিসেবে)।
অনলাইন ক্লাসের বাইরেও এর অনেক দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা ও ফলাফল পাওয়া যাবে। অনলাইন/ সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য, আ্যসাইনমেন্ট তৈরি করা, রিয়েলটাইম পরীক্ষা দেয়া, প্রেজেন্টেশন তৈরি করাসহ অন্যান্য বিষয়ে স্মার্টফোনের থেকে ল্যাপটপের সুবিধা অনেক।
এখন জরুরি ভিত্তিতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলোচনা করে প্রথম পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে এবং ঈদুল ফিতরের পরেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারে।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ প্রথমবারের মতো অনলাইনে এমবিবিএস সমাপনী পরীক্ষা নিয়েছে। অনলাইনে মিডটার্ম প্রেজেন্টেশন, মৌখিক পরীক্ষা, আ্যসাইনমেন্টসহ ফাইনাল পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন সেটা করছে।
আর তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও আর বসে থেকে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আর সরকার যদি আর্থিক সহায়তা নাও দেয়, প্রত্যেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে আর্থিকভাবে দূর্বল শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন ও ডাটা কেনার খরচ দিয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ২৬ কোটি টাকা লাগবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর জন্য, এই খরচ বহন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সক্ষম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে ঈদের পরবর্তী এই সময়ে অনলাইন ক্লাস শুরু করতে পারে। শুরুতে সমস্যা থাকবে, আস্তে আস্তে সমস্যার সমাধানও করা যাবে।
আর কোভিড-১৯ মহামারী থাকুক আর নাই থাকুক, আগামী বছরের শুরু থেকেই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বিকল্প চালু করা উচিত। মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক- অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।