পৃথিবীতে কি আবার পূর্ণাঙ্গভাবে ধর্মযুদ্ধ ফিরে আসছে?
বিগত শতাব্দীতে ধর্মযুদ্ধ কিছুটা মন্থর হয়ে পড়েছিল। এই উপমহাদেশের কাশ্মীর, মধ্য ইউরোপের দেশ বসনিয়া আর ফিলিস্তিন এবং রুয়ান্ডার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এসব যুদ্ধের পেছনে ছিল ধর্ম; যদিও যুদ্ধের কারণ হিসাবে ধর্মকে কিছুটা লুকিয়েই রাখা হতো। এটা গত শতাব্দীর কথা।
শতাব্দীর প্রথম থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বাতাসে আফগান তালেবান আন্দোলনের শরীয়া দর্শন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আফগান ও ইরাকের পর সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে জন্ম নেয় সেই শরীয়া দর্শন প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের এই বৃহৎ দেশগুলোর রাষ্ট্র ব্যবস্থা, এ সময়ে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।
ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও। দেশটি তার মৌলিক সমাজ দর্শন থেকে পিছন দিকে চলতে শুরু করেছে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের শহরে জন্ম নেওয়া সুব্রামনিয়াম স্বামী, রাজ্যসভার বিজেপির মনোনীত সদস্য, তিনি সম্প্রতি তার বক্তৃতায় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মতো পৃথিবীর সভ্যতাকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার হুমকি দিয়েছেন। পশ্চিম বাংলার আরেক কংগ্রেস নেতা অধির চৌধুরী প্রায় একইভাবে সুর চড়িয়েছেন প্রতিবেশি বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও।
বর্তমানে ভারতের চতুর্দিকের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশর সঙ্গেই দেশটির সম্পর্ক প্রকাশ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ, সেখানে ধর্মীয় সহিংসতার কথা বলে প্রকাশ্যে এই হুমকি কতটা বুদ্ধিদীপ্ত? এ প্রশ্ন করাই যায়।
সমাজে নানা শ্রেণির দ্বন্দ্বের মধ্যে ধর্মের দ্বন্দ্ব সব সময়ই আছে, কখনো তা লুকায়িত আর কখনো প্রকাশ্য। তবে সব সময়ই শাসককূল এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন চলছে। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপির ক্ষমতায়নের নতুন মাত্রা যোগ করে মোদিজীর সরকার। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কটাকে গভীর ধূসর পথে ঠেলে দেয় তারা। নাগরিকত্ব আইন, গরু সংরক্ষণ, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল, এনআইআরসি- সবই একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে।
আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত উত্থানের পথে চলছে ভারত। ভারত বিভক্তিকালেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছিল। তবে ধর্মীয় হিংসা হয়তো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে তখন।
প্রতিটি সভ্যতা আলাদা; তার সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস পরিশেষে ধর্ম। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে সভ্যতার নতুন বিকাশ শুরু হয়। ইউরোপ বুঝতে পারে, শিল্প বিপ্লবের এই ফসল ঘরে তুলতে হলে, চলমান রেনেসাঁ আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ইউরোপের দেশগুলোকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে হবে। তারা তা করতে সক্ষম হয়, এবং সেই বিকাশের ধারা থেকেই আমরা পাই আজকের ইউরোপীয় দেশগুলো।
এই দেশগুলোর মধ্য ধর্মীয় সংঘাত দেখা দেয় গত শতাব্দীতে। সর্বশেষে উদাহরণ ছিল বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধন। পরের ঘটনা হিসেবে যোগ হলো, বলকান অঞ্চলের যুগোস্লোভিয়া সংকট: সেই সময়ের যুগোস্লোভিয়া যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে সাতটি নতুন দেশ, নতুন ধর্মভিত্তিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হলো।
এই শতাব্দীর শুরু থেকে ভারতীয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটে প্রতিবেশি মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আরও সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জন্ম হওয়া পাকিস্তান দেশটির সামরিক চক্র ও তাদের ক্ষমতার সাথীরা প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে সংঘাত ঘটিয়ে চলছিল। যার সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের ক্ষমতায় দেখছি প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খানকে। দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ভূখণ্ডের মতো একটি নিয়ন্ত্রহীন সমাজে পরিণত হয়েছে। সামরিক বাহিনী যখন যা প্রয়োজন, তাই করছে। পুরোটাই ধর্মের আড়ালে।
আর ভারত নিজ ভূখণ্ডের মানুষকে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা কতটা নিজ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়েও বিরাট প্রশ্ন।
সম্প্রতি ফ্রান্সের ঘটনায় ধর্মীয় জনগোষ্ঠী যে হুংকার ছড়াল, তা নিশ্চয়ই গভীর ভাবনার বিষয়। এই ধর্মীয় জনগোষ্ঠী দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কথা মনে না রেখে যে বিষবাস্প ছড়াল, এটা যে কত ভয়ংকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এদের সঙ্গে সুর মেলাল দেশের পার্লামেন্টের সদস্য জাতীয় পার্টি।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য বলা যায় তৈরি পোশাক; আর এর প্রধান ক্রেতা ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলো। আমাদের এই পোশাক খাতকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম বলা যায়। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে আরেক ধর্মীয় জাতিয়তাবাদী ফ্রান্সের বিরোধী দলের নেত্রী লি পেন এ দেশের তৈরি পোশাক বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও ইউরোপে এ রকম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়নি।
ওদিকে, মার্কিন নির্বাচনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে সামনে এসেছে ট্রাম্পের বাইবেল প্রদর্শন; তবে শেষ পর্যন্ত বাইডেনের জয়ে ট্রাম্পের বাইবেল প্রদর্শন কোনো কাজ করে নাই প্রমাণ হলো। জো বাইডেনের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক নতুন মাত্র যোগ হলো, পৃথিবী এই মহা শক্তিধর দেশটির প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট দেখতে পেল। তবে নারীদের ভোট অধিকার অর্জনের ৫৫ বছর পরে এই যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল। যদিও এক্ষেত্রে মার্কিন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা যথেষ্টই সক্রিয় ছিল বর্ণবাদী প্রচারের মাধ্যমে। কমলা হ্যারিস ভারতীয় মাতার সন্তান। তার মায়ের জন্ম ভারতে। ১৯ বছর বয়সে তার মা তামিলনাড়ু ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন।
তবে দেশে দেশে ছিড়িয়ে পরা এই ধর্মতত্ত্ব থেকে বেশ কিছুটা দুরে আছে চীন, যদিও তার নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড জিনজিয়ান আর তিব্বতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সংকট রয়েছে। দেশটির মূল ভূখণ্ডে আর ঐ দুই ভূখণ্ডের মানুষ ছাড়া অন্যত্র কোনো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না বলা যায়। এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণই চীনের চালিকা শক্তি।
গত শতাব্দীতে মাওয়ের নেতৃত্বে যে কৃষক বিপ্লব সংগঠিত হয়, সেই ১৯৪৯ সাল থেকে সমাজে ধর্মের ভূমিকা নির্ধারিত করে ফেলার ফলে চীনের প্রধান ভূখণ্ড ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ তাইওয়ান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম কিংবা জাপান- সর্বোপরি এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলো তাদের সমাজে মঙ্গোলিয়ান জাতি সত্তার সঙ্গে ধর্মকে প্রাধান্য দেয় নাই। ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে ব্যক্তির কাছেই রেখেছে ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো।
ভারত ও চীন প্রায় একই সময়, অর্থাৎ ১৯৪৭ আর ১৯৪৯ সালে দুটি নতুন যাত্রা শুরু করে। সেই সময়ে এ দু'দেশের অর্থনীতি প্রায় একই ছিল; তবে চীনের জনসংখ্যা ছিল বেশি। যদিও চীন মাওয়ের জীবিতকালেই পাঁচ কোটি মানুষ হারিয়েছিল, তিন বছরের ১৯৫৯-৬১ এক মহাদুর্ভিক্ষে। কিন্তু ভারতকে এ রকম অবস্থায় পড়তে হয়নি কখনো। তবে জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে, তথা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে চীন থেকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে দেশটি।
চীন ও ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা অন্য সব সামাজিক পরিসংখ্যান তুলনাযোগ্য নয়। ভারতের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক