জেনে নিন বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার সূচকে আমাদের অবস্থান কোথায়
যখনই কোনো বৈশ্বিক সূচক প্রকাশিত হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো আমাদের জন্য খারাপ খবর নিয়ে আসে; দেখেই মন খারাপ হয়ে যায় আমাদের।
আইনের শাসনই বলুন, কিংবা গণতন্ত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা- সমস্ত র্যাঙ্কিং বারবার বাংলাদেশের খারাপ অবস্থার বিষয়টাই প্রকাশ করে। বিশ্বের 'ওয়াচডগ'রা স্বতন্ত্র নজরদারির মাধ্যমে আমাদের নির্দয় বিচার করছেন প্রতিনিয়ত।
সম্প্রতি বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগতমাণ নিয়ে একটি সূচক প্রকাশ করেছে ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এরাও সেই পুরনো কথাই বলছে- 'দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। এদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অস্বাভাবিক রকমের অভাব রয়েছে; এরা ধনী ব্যক্তি আর অপরাধীদের অর্থ লুকিয়ে রাখতে এবং ঋণ খেলাপ করতে দেয়।' এ ধরনের কথাবার্তা আমাদের জন্য খুব নতুন কিছু নয়।
শুধু তাই নয়, প্রতি বছর প্রকাশিত আরও কয়েকটি বড় বৈশ্বিক সূচক দেখলেও একই রকম কথা পাব; ব্যাপারটি এমন, যেন আমরা আগে থেকেই জানি, তারা কি বলবে। এখন আর তাই এইসব ফলাফল আমাদের অবাক করে না।
বেশ কয়েক বছর ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি অনুধাবন সূচকে আমরা ক্রমাগত নিচের দিকেই আছি। দুর্নীতি দমনে আমাদের সমস্ত পদক্ষেপ অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ারই ইঙ্গিত করে এটি।
আইন ব্যবস্থার কার্যকর নিয়ম চালু করা ছাড়া দুর্নীতি কমানো সম্ভব না। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের আইনের শাসনের অবস্থাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কারণ ২০১৯ সালের আইনের শাসনের সূচকে আগের বছরের মতোই বিশ্বের ১২৬টি দেশের মধ্যে ১১২তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
আইনের কার্যকর শাসন শুধু দুর্নীতিই কমায় না, জনগণের দারিদ্র্য আর রোগের সঙ্গে লড়াই করে এবং মানুষকে অন্যায় থেকে সুরক্ষা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ন্যায়বিচার, সমান সুযোগ এবং শান্তির সম্প্রদায়ের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে; উন্নয়ন, জবাবদিহিতামূলক সরকার এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে।
সাধারণত আইনের শাসন মানে আমরা শুধু আইনজীবী আর বিচারকদের কাজের গণ্ডিকেই বুঝি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিনের সুরক্ষা, অধিকার, ন্যায়বিচার এবং প্রশাসনের বিষয়গুলো আমাদের সকলকে প্রভাবিত করে। তাই রাষ্ট্রের সবাই আইনের শাসনের অংশীদার।
আর একটি দেশের আইনের শাসনই দেশটির সুষ্ঠু গণতন্ত্রের সূচক হিসেবে কাজ করে।
তিন দশক আগে গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের পর বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সূচকে 'হাইব্রিড রেজিম' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল দ্য ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। হাইব্রিড সরকার মানে- যে শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে স্বৈরাচারী বৈশিষ্ট্য মিশে থাকে।
একটি প্রাণবন্ত সজীব গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি অপরিহার্য উপাদান, যা বাংলাদেশে অনেকাংশেই অনুপস্থিত- রিপোর্টার্স উইথ বর্ডারসের 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম' সূচকের ফলাফল তাই বলছে।
যে রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই, সে রাষ্ট্র একটি জবাবদিহিতামূলক সরকার গঠন করার পক্ষে শক্ত ভূমিকা নিতে পারে না।
রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাব দুর্বল প্রশাসনের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ। জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে এই অপসংস্কৃতির চর্চা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করতে আরও উৎসাহিত করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সার্বিক অর্থনীতি।
এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সেরা চর্চাগুলো থেকে খুব কমই শিখতে পেরেছি আমরা।
সুইডেন স্বচ্ছ আর জবাবদিহিতামূলক সরকারের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
আজ থেকে আড়াইশ' বছর আগে সুইডেন গণমাধ্যম এবং তথ্য অধিকার নিশ্চিতকারী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গোপনীয়তা রোধে একটি আইন চালু করেছিল। ১৯৬০-এর দশকে এসে দেশটিতে এই আইনের বাস্তবায়ন হয়।
সুইডেন এখন একটি অবাধ ও মুক্ত সমাজ। এর সরকার দেশের জনগণের কাছে তথ্য প্রকাশ করতে আইনত বাধ্য। দুর্নীতি, আইনের শাসন, গণতন্ত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা- যে বিষয়েই হোক না কেন, প্রায় প্রতিটি বৈশ্বিক সূচকেই দেশটির প্রশংসা করা হয়।
সুইডেনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা ও জীবনযাত্রার মানও প্রশংসনীয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে আরেক উজ্জ্বল উদাহরণ।
আজ থেকে ২৩০ বছরেরও আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সাংবিধানিক বিধান প্রবর্তন করে বলেছিল, বাকস্বাধীনতা, সংবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে- এমন কোনো আইন কংগ্রেস করতে পারবে না।
এটি দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে, অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে, প্রশাসনের কর্মীদের জবাবদিহিতা এবং ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখছে।
সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে মানুষের এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র ভয় দেখাবে না। কেননা ত্রাসের পরিবেশে কাজ করতে করতে মানুষের মনের সৃষ্টিশীল আর গঠনমূলক আইডিয়া মরে যায়।
যাই হোক, বাংলাদেশের সমস্ত অপ্রীতিকর ফলাফলের পরেও আমরা কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারি।
কিছু বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করেছেন। আমরা বিশ্বের পাঁচটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। দারিদ্র্য ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস পাওয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আমাদের সাফল্য প্রশংসা পাচ্ছে।
তবে বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী স্বতন্ত্র 'ওয়াচডগ'দের নজরদারি আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গুণমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদিও জিডিপি- যা শুধুমাত্র এক বছরে আমরা যে পরিমাণ পণ্য এবং পরিষেবাদি উৎপাদন করি তা পরিমাপ করে, সেটির পক্ষে আমরা আদৌ ভালো আছি কি না- সেই পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
আমাদের অর্থনীতি একটি প্রতিকূল পরিবেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের 'ডুইং বিজনেস' সূচকে ১৪৮তম অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বছরের পর বছর ধরে, বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এছাড়াও অন্যান্য সূচক- যেমন কর্মসংস্থান, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং সামাজিক অবিচার; শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের নিম্নমান বিবেচনা যদি করি, তাহলে আমরা গর্ববোধ করতে পারি না। তার উপর পরিবেশের অবক্ষয়, অসুস্থ ব্যাংকিং খাত এবং দুর্বল পুঁজিবাজার তো রয়েছেই।
আর এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী নজরদারিগুলো অবিরাম নির্দয়ভাবে আমাদের বিচার করতে থাকবে, যতক্ষণ না আমরা তাদের সূচকগুলোতে নিজেদের র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি ঘটাতে পারি।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোকে সুশাসনের উদাহরণ হিসাবে ধরতে পারি আমরা। সমস্ত বিশ্ব সূচকের শীর্ষে রয়েছে সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশের অর্থনীতির চেয়ে তাদের প্রবৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান ভালো।
বিশ্বের সেরা এই দেশগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে যদি আমাদের র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি ঘটাতে পারি, তাহলে বিশ্বে একটি উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি গড়তে পারব আমরা।