বেসিক সেক্স এডুকেশন থাকলে ধর্ষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব
সাত-সকালে পত্রিকা হাতে নেওয়ার বহু পুরনো অভ্যাসটা আস্তে আস্তে নষ্ট হতে বসেছে। একের পর এক ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার খবর দেখে গা গুলিয়ে ওঠে। তবে অন্ধ হলে যেমন প্রলয় বন্ধ থাকে না, ঠিক তেমনি অন্যায়ের খোঁজ না রাখলে অন্যায়ও থেমে যায় না। কিন্তু এই অপরাধের শেষটা কোথায়?
ধর্ষণ বাংলাদেশে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যে ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না দুই বছরের শিশু কিংবা সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা। ধর্ষণ বেড়ে গেছে নাকি গণমাধ্যমে প্রচারের কারণে ধর্ষণের ঘটনা বেশি চোখে পড়ছে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮৯ জন নারী ও শিশু। ১৯২ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম না।
নারী আজ কোথায় নিরাপদ? ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, দিনে-রাতে পরিচিত-অপরিচিত কেউ কি নারীকে ছাড় দিচ্ছে? তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষাব্যবস্থার এত শত উন্নয়নের পরও কি দিন শেষে এটাই সত্যি যে নারী কেবলই ভোগ্যপণ্য?
আমাদের দেশের কমন একটি প্র্যাকটিস হলো অপরাধের নতুন কোনো ধরনের কথা জানাজানি হলে একই প্যাটার্নের অপরাধের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। যেমন, চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেওয়া, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা, হত্যার পর মাথা কেটে ফেলা। ভারতে চলন্ত বাসে নির্ভয়া ধর্ষণের ঘটনার পর বাংলাদেশেও একের পর এক এ ধরনের ধর্ষণ ঘটতে থাকে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের রূপা খাতুন, কিশোরগঞ্জের নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া, ধামরাইয়ের নারী শ্রমিক মমতা বেগমকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এছাড়াও গণপরিবহনে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন নাম না জানা অনেকে। সম্প্রতি বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার যে ঘটনাটি ঘটল, এই অপরাধের ট্রেন্ড যদি চলতে থাকে তাহলে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন?
ধর্ষণের শিকার নারীর নাম আমরা জানি না। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থার ধারণা, যার সাথে এত বড় পাপাচার হলো অপরাধী আসলে সে। ধর্ষকের নাম ভুলে গেলেও ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ঠিকুজি-কুষ্ঠি আমরা ঠিকই মনে রাখি। সারাজীবন ভুলতে দেই না ধর্ষক বা তাদের দোসররা মেয়েটিকে কী দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। অথচ ধর্ষণের শিকার নারীকে কীভাবে সম্মান করতে হয় তা শিখিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা মেয়েদের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। আর ঠিকানা লিখে দাও ধানমন্ডি ৩২।' আফসোস, এই শিক্ষা আমরা ভুলে গেছি।
এ প্রসঙ্গে ভারতের উন্নয়নশীল নারীবাদী কর্মী কমলা ভাসিনের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়। আমির খানের জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান 'সত্যমেব জয়তের' এক এপিসোডে কমলা বলেছিলেন, কোনো মেয়ে ধর্ষিত হলে সমাজ বলে মেয়েটির ইজ্জত চলে গেছে। নারীর যোনিতে কেন তার ইজ্জত থাকবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতে, একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে তার পুরো সম্প্রদায়ের সম্মান নষ্ট হয়। কিন্তু মেয়েটির কারণে কেন সমাজের সম্মান নষ্ট হবে? বরং অসম্মান তো হওয়ার কথা ধর্ষকের জন্য।
যে সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা মেয়েদের সুরক্ষা দিতে পারে না, মেয়েদের পোশাক, চলাফেরা নিয়ে তারাই আঙুল তোলে। একদিকে সম্ভ্রম বাঁচাতে ধর্ষককে আব্বা বলে ডাকছেন নারী, আরেকদিকে জন্মদাতা বাবার কাছেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অসহায় কিশোরী। তবুও এই দেশে জনপ্রিয় হয় 'মাইয়ারে মাইয়া তুই অপরাধী রে' জাতীয় গান। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকের মতো বলতে হয়, সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ!
ধর্ষণ নারীর শরীরের সাথে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা। এখানে নারীর বিন্দুমাত্র কোনো দোষ নেই, থাকতে পারে না। তবুও ব্যবসায়িক স্বার্থ মাথায় রেখে টিআরপি বা ভিউ বাড়ানোর জন্য কিছু অনলাইন পোর্টাল বা টেলিভিশন চ্যানেল ধর্ষণের এমন রগরগে বর্ণনা দেয়, যার কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ধর্ষিত হয় বারংবার। কমলা ভাসিনের মতে, ছেলেদের ধর্ষকামী মনোভাবের মূলে আছে সামাজিক বৈষম্য, অবিচার, ক্ষমতা জাহির করার প্রবণতা। সমাজ কাঠামো মেনে নিজেকে ক্ষমতাশালী ভেবে প্রায় সব শ্রেণির পুরুষই নারীর ওপর বল প্রয়োগ করে।
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম যেমন স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় চাহিদা, ঠিক তেমনি পরিণত বয়সে যৌন চাহিদাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু সেই চাহিদা কখনোই গায়ের জোরে মেটানো যাবে না। কথায় আছে, A nation is known by its citizen। ধর্ষকামী জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঠাঁই পাওয়া নিশ্চয়ই আমাদের গৌরবের কারণ হবে না। তাই নারীর পোশাক, চলাফেরা নিয়ে খুঁত ধরে ভিক্টিমের ওপর দোষ না চাপিয়ে বরং নিজেদের মানসিকতা উন্নত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যৌনতার বেসিক ধারণা, কনসেন্ট বা সম্মতি নিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন আর জোরপূর্বক ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য, ঋতুস্রাব বা সন্তান ধারণের কনসেপ্ট যদি বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বুঝিয়ে দেওয়া যায় তাহলে যৌনতা তাদের কাছে ট্যাবু মনে হবে না। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু যৌনতার ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এবং বেসিক সেক্স এডুকেশন থাকলে ধর্ষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আর সেই সঙ্গে ধর্ষকদের যথাযথ বিচার কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকুক চলমান আন্দোলন।
- লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়