ভার্চুয়াল ঈদ-২০২০ বনাম আমাদের শৈশবের ঈদ
সম্ভবত ১৯৭৩ সাল। একটা ছোট্ট মেয়ে তার বাবার হাত ধরে ঢাকা নিউমার্কেটে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যাচ্ছিল আর জিজ্ঞেস করছিল, "চেক চেক বুটি বুটি শাড়ি আছে?"
৬-৭ টা দোকান ঘুরে একটি দোকানে তারা পেল মেহেদী রঙের মধ্যে জরির চেক আর ছোট জরির বুটিওয়ালা সেই কাঙ্ক্ষিত সুতির শাড়িটা। এই শাড়িটা তারা বাবা মেয়েতে মিলে কিনে ফেলল, ঈদে মাকে চমকে দেবে বলে। মায়ের অনেকদিনের ইচ্ছা এরকম চেক-বুটি একটা শাড়ি পরার।
মেয়েটির মা 'সাপ্তাহিক ঝিনুক' ম্যাগাজিনে কোনো এক নায়িকাকে এরকম একটা শাড়ি পরতে দেখেছিল। কিন্তু সংসারের চাপে-তাপে আর কেনা হয়ে ওঠেনি। কাজেই ঈদেই তারা বাবা-মেয়ে মিলে এই উদ্যোগ নিল।
বাবা সাংবাদিক ছিল বলে ঈদের দুয়েক দিন আগে বোনাস হতো, খুব সামান্য কিছু টাকা। এই সামান্য টাকা থেকেই সেইসময় অসামান্য আনন্দ পেয়েছিল মেয়েটি আর মেয়েটির বাবা। আর এই উপহার পেয়ে মা তো খুশিতে হতবাক। মায়ের সেই খুশি ঝলমলে চেহারাটা এখনো মেয়েটির চোখে ভাসে।
মাঝে অনেকগুলো ঈদ চলে গেছে। সেই মেয়েটি ছোট থেকে বড় হয়েছে। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছে তার উপরে। এখন সে আর বাবার হাত ধরে কেনাকাটা করতে যায় না, বরং নিজেই অন্যের জন্য কেনাকাটা করে। সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে বড়দের জন্য ঈদটা শুধু দায়িত্ব। আর ঈদের আনন্দটা শুধু ছোটদেরই জন্য।
সত্যি, এখনও যখন ঈদের কথা ভাবি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার শৈশবের সেই ভালোবাসাময় সাদামাটা ঈদ।
আমরা জানি ঈদ মানে আনন্দ, উৎসব ও আয়োজন। তবে এ বছর ঠিক বিপরীত একটি ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য এমন বিবর্ণ একটা ঈদ এসেছে, যা আগে কখনো আসেনি।
অদ্ভুত এক অন্ধকারে ঢেকে গেছে পৃথিবী। চারিদিকে মৃত্যু, ক্ষুধা আর হাহাকারের মিছিল। কাছাকাছি না থেকে দূরে থাকারও দিন এসেছে। নিদানকালের এই ঈদে তাহলে আমরা কী করতে পারি?
একজন ধারণা দিল, যেহেতু ঈদে অন্যের বাড়িতে যাওয়া যাবে না, ভাইবোনেরা বা বন্ধুরা একটা জুম মিটিং করে ফেলতে পারি সকাল সকাল। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে আবার না হয় ঢুকে যাব দৈনন্দিন কাজে। রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া এমনকি অফিসের মেইল চালাচালিও করা যেতে পারে।
যারা করোনা মাথায় করে ঈদের কেনাকাটা করেছেন, তারা অনলাইনেই বন্ধুদের কাপড়-মেকআপ দেখিয়ে দিতে পারেন। খামোখা বন্ধুর বাড়ি গিয়ে করোনা ছড়িয়ে লাভ নাই।
ডিজিটাল এই দুনিয়ায় আপ্যায়ন, গল্প, ডেটিং, শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময় সবই চলতে পারে ভার্চুয়ালি। টিভিতেও থাকছে না বিশেষ কোনো ঈদ আয়োজন।
এমনকি কোনো স্কুল যদি মনে করে ঈদের এই ছুটিতে একটা পরীক্ষা নিয়ে ফেলবে অনলাইনে, তাও তারা পারবে। কারণ ঈদের ছুটির হিসাব কষার সেই উত্তেজনা এখন আর কেউ বোধ করছেন না।
আর তাই প্রথমবারের মতো সংবাদপত্রও ৬ দিন বন্ধ দিয়ে দিল। এমনিতেই আমাদের জীবনে ঈদের আনন্দ হালকা হয়ে আসছিল, এর মধ্যে এরকম একটি নিরানন্দময় ভার্চুয়াল ঈদ আমাদের আরও দূরে সরিয়ে দিল যেন।
অথচ ছোটবেলায় ঈদের দিনটি যতো এগিয়ে আসত, আমাদের আনন্দ ততই বেড়ে যেত। শুধু ভাবনা ছিল নতুন কাপড় পরে পাড়া বেড়ানো আর মজার মজার খাবার খাওয়া। আমরা শুধু দুই ঈদেই ভালো কাপড় ও জুতা পেতাম। ঈদে কার জামা কেমন হবে, তা লুকানোর জন্য ছিল পড়িমরি চেষ্টা। আমাদের ছোটবেলায় এত চাকচিক্য ছিল না। অনেক না পাওয়ার মধ্যে তাই ঈদের এই পাওয়াটা ছিল অনেক বেশি কিছু।
এখন যেমন ঈদ উপলক্ষে নতুন আসবাব, গয়নাগাটি, শাড়ি, কাপড়, পর্দা, চাদর, হাড়ি-পাতিল, ক্রোকারিজ- কোনো আইটেমই কেনাকাটা থেকে বাদ যায় না। কিন্তু, তখন অবস্থাটা সেরকম ছিল না। তবে কেমন ছিল সেসময়ের ঈদের দিনের গৃহসজ্জা?
আমাদের মতো সব বাসাতেই ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে বাসার চাদর, টেবিল ক্লথ, সোফার কভার, পর্দা সব ধোলাই করা হতো। ওই কয়েকটা দিন আমাদের বেশ আবরণহীন অবস্থায় থাকতে হতো। সবকিছু ধুয়ে, কড়া করে মাড় দেওয়া হতো। ঈদের আগের রাতে আমরা বসে বসে ঘরের পর্দা লাগাতাম, সোফার কভার ভরতাম। পুরনো জিনিস নতুন করে সাজানোর সে এক অন্যরকম আনন্দ ছিল।
পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে কিছু ফুল, পাতা এনে ঘর সাজাতাম। ঈদ উপলক্ষে আম্মা কুরুশ কাঁটার টেবিল ক্লথ, ড্রেসিং টেবিলের ঢাকনা- এসব বুনতে বসে যেত। পুরনো চাদরে নতুন করে ফুল তুলত, কাট ওয়ার্কের কাজ করত। ৭০/৮০-এর দশকে এরকম ঈদ অভিজ্ঞতা ঢাকা শহরের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারেরই আছে।
ঘর সাজানোর পর শুরু হতো রান্নার আয়োজন। ঈদের দিন ভোর থেকে রান্নার গন্ধে ঘুম ভেঙে যেত - সেমাই, জর্দা, পোলাও, কোরমার গন্ধ। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আম্মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলতেন। আম্মার বহু শখের ক্রোকারিজগুলো সেদিনই শো-কেস থেকে বের করা হতো। আব্বা আর ভাই নামাজ থেকে ফিরে এলে সবাই একসঙ্গে বসে নাস্তা খাওয়া এবং তারপরই নতুন কাপড় পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়া।
রোজার ঈদের আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিল সালামির টাকা। দু'দশ টাকা করে ১০০ টাকার মতো সালামি পেতাম। অন্যান্য দিন যা যা কিনে খেতে পারতাম না, তাই খেতাম বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। যতদিন এই টাকা হাতে থাকত, ততদিন নিজেকে রাজা রাজা মনে হতো। রাতের খাবার খেয়েই বসে যেতাম বিটিভি'র সামনে ঈদের আনন্দমেলা ও নাটক দেখতে।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের আজকালের ঈদ এবং আমাদের ছোটকালের ঈদের সবকিছুর মধ্যেই অনেক ফারাক হয়ে গেছে। তখন ঐশ্বর্য ছিল কম; কিন্তু আনন্দ ছিল বেশি। আমরা অনেক কিছু পেতাম না; কিন্তু যা কিছু পেতাম, তা তারিয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতাম।
আজকালকার শিশুরা এত জামা-কাপড় পায়, এত খেলনা, খাওয়া দাওয়া পায় বলে হয়তো ঈদের জামা-জুতো কেনার আনন্দটা তারা সেভাবে উপলব্ধিই করতে পারে না।
যাহোক, এ বছর ঈদে করোনার কারণে দিন-রাত এক করে কেনাকাটা করা, চাঁদ রাতে ঘুরে বেড়ানো, বাজি ফুটানো, নতুন কাপড়-আসবাবপত্র-গৃহের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, ঈদের উপহার দেওয়া-নেওয়া, গ্রামে যাওয়া, বাবা মায়ের কাছে ফেরা, শহরময় ঘুরে বেড়ানো, দেশে-বিদেশে ছুটি কাটাতে যাওয়া সব বন্ধ। এমনকি ক্ষমতা থাকলেও আমাদের উচিত হবে না কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেকগুলো দেশেরই মুসলিম নেতৃবৃন্দ বলেছেন সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে বলে ঈদ করতে হবে ভার্চুয়ালি। ভারত, ব্রিটেন, সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান, তুরস্ক সবখানেই ঈদ হবে অনেকটাই ঘরবন্দি অবস্থায় এবং কোথাও কোথাও কারফিউয়ের মধ্যে। কাজেই সবাই মিলে এই দুঃখ পুষিয়ে নেওয়া যাবে!
যারা চাকরি করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ ঈদ বোনাস পাওয়া। এবার সেই বোনাসের উপরেও চাপ পড়েছে। কেউ পাচ্ছেন, কেউবা অর্ধেক পাচ্ছেন, আর কেউবা পাচ্ছেনই না। কেউ কেউ তো গত দুইমাসে কোনো আয়ই করেননি। সেইসব মানুষের ঈদ কোথায়?
দেশে অগণিত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ আজ পেটপুরে খেতে পারছেন না। কোথাও কোনো কাজ নেই তাদের। দিনে দিনে আরও অনেক মানুষ বেকার হবেন। এই করোনার মধ্যেই আম্পান ঝড়ে উপকূলের মানুষ হয়েছেন গৃহহীন, সম্বলহীন।
যেহেতু ঈদের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার ব্যয় আমাদের কমে গেছে, এখন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যদি কিছু দান করেন, তবেই নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের মুখে কিছু হাসি ফুটবে।
অসহায় মানুষ যদি আপনার দেওয়া টাকায় দু'গ্রাস ভাত মুখে তুলতে পারেন বা একজন মানুষও যদি তার বাড়িভাড়ার টাকাটা দিতে পারেন বা ঝড়ে উড়ে যাওয়া চালটা ঠিক করতে পারেন বা একটা গরু-ছাগল কিনতে পারেন, তবে সেটাই হবে আমাদের জন্য অনেক পাওয়া।
শৈশবে অল্প কিছু নিয়ে আমরা তৃপ্ত ছিলাম। সবাই সমানভাবে একসঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম।
অথচ মাঝখানে আমরা অনেকটাই বদলে গিয়েছি। ঈদ মানেই ছিল বিলাসী ব্যয়। যারা পারছে তারাও করছে, যারা পারছে না তারা ছিনিয়ে নিয়ে করছে।
এই করোনার কারণে সৃষ্ট অভাব আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল 'সাধ্যের বাইরে যে সাধ তা কালে পূরণ হবার নয়, সাধ্যের মধ্যেই আছে সকল সত্য।'
আসুন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচি। আর সেটাই হবে এই করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে ভার্চুয়াল ঈদের আনন্দ।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন