মাৎস্যন্যায় সমাজের ধারাবাহিকতা এখনও চলছে
বাংলাদেশের স্বনামধন্য শীর্ষ আমলাদের একজন আকবর আলী খান। দীর্ঘকাল সরকারের আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন উচ্চপদ অলংকৃত করে অবসরকালে দেশ ও সমাজ
নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী কাজ ও তার ওপর বিভিন্ন প্রকাশনা করেছেন। প্রথমা প্রকাশন জনাব খানের বিভিন্ন বই প্রকাশ করেছে। 'অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি', এমনই একটা বই। জনাব খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছিল।
আকবর আলী খান তার এই বইটিতে আদিকাল অর্থাৎ বাংলা তথা ভারতীয় সমাজের ইতিহাসভিত্তিক এক দীর্ঘ আলোচনায় দেখিয়েছেন: বাংলা তথা ভারতের প্রধান অংশে কখনও সমাজ গঠিত হয় নাই। ইতিহাসের নানা অংশ তুলে ধরে প্রায় দুহাজার বছরের অধিককাল যে শাসনব্যবস্তা কায়েম ছিল তা ছিল খুবই ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী।
ওই সময়কালের শাসনব্যবস্থা ছিল মাৎস্যন্যায় সমাজের মতোই। অর্থাৎ মৎস সমাজে যেভাবে বড় মাছ ক্ষুদ্র মাছের বিনাশ করে এই পুরো সময়কাল সমাজ সে রকমই ছিল। দীর্ঘকালের এই ইতিহাসে কোন রাজবংশ দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই। এমনকি কোনো কোনো সময়ে পাঁচ বছরের বেশি স্থায়ী হয় নাই এরকম শাসনব্যবস্থাও দেখা গেছে বলে তার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। প্রায় ক্ষেত্রেই সেনাপতি রাজাকে হত্যা করে নিজেই রাজা বনে গেছেন। অন্য সকল অংশের মানুষ তাদের বশ্যতা মেনে নিয়েছে।
মুসলিম সুলতানদের সময়কালও একইভাবে কেটেছে। সুলতানরা গড়ে সর্বোচ্চ সাত থেকে দশ বছর শাসন করেছে। এমনকি মোগলদের শাসনামলেও একই অবস্থা ছিল। খ্রিস্টাব্দ ৫০০ কাল থেকে ১০০০ সাল পর্যন্ত কোন রাজবংশ ৮০ বছরের উপর শাসন করে নাই।
মাৎস্যন্যায় ওই সমাজের ধারাবাহিকতা আজও বহাল আছে। বাংলার এই ভূখণ্ডে সমাজ কখনও গঠিত হয় নাই। যে কারণে সমাজের কোনো উত্তোরাধিকারীত্ব কখনও হয় নাই, ব্রিটিশ শাসকদের ভারত দখল কালপর্বও তাই ছিল। যে কারণে প্রায় ২০০ বছর এ দেশে ব্রিটিশ রাজত্ব বজায় থেকেছে। বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে সবাই ব্রিটিশ দখলদারিত্ব মেনে নিয়েছে মোটা দাগে।
ব্রিটিশ শাসন অবসান হয়েছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবদের খপ্পরে পড়ে। যে ভারতে মুসলিমদের আগমন ও বিকাশ হয়েছিল আদি অন্যসব ধর্মালম্বীদের সহঅবস্হানে, সেখানে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা শুধু ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার ছিল। ভারত বিভক্তির পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল লর্ড মাউন্টব্যাটনের স্ত্রী এডউইনা মাউন্টব্যাটেন। জনাব খান দেখিয়েছেন এই বহুগামী নারীর সঙ্গে কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল নেহেরুর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন একজন সমকামী পুরুষ ছিল, যে কারণে তার স্ত্রীর অবাধ যৌন জীবন মেনে নিয়েছিল।
ব্রিটেনের এ্যাটলি সরকার মাউন্টব্যাটেনকে ১৯৪৭ সালের মার্চে বিলেত থেকে ভারতে প্রেরণ করে ভারতের শেষ ভাইসরয় হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে। ব্রিটিশদের ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভারত ত্যাগের সময়সীমা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল ১৯৪৬ সালেই।
জনাব খান তার এই বইটির প্রথম অধ্যায়ে সামাজিক পুঁজির বিষয়েও উল্লেখ করেছেন। তিনি উদাহরণ হিসাবে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাসের কথা বলেছেন। তিনি এক হিসাবে উল্লেখ করে দেখিয়েছেন এই ভুখণ্ডের মাত্র ২৩% মানুষ পরস্পরকে বিশ্বাস করে যা কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। সামাজিক উত্তোরাধিকারীত্ব ছাড়া কথনও সমাজের টেকসই কোনো উন্নতি হয় না। সামাজিক পুঁজির বিকাশের অভাবে শাসক শ্রেণির মধ্য সমঝোতা হয় না। ১৯৪৭ সাল থেকে আজ অবধি তাই বহাল আছে।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যে শাসকচক্রের হাতিয়ার তা উপলব্ধিতে আসল যখন ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেল। ভাষা থেকে স্বায়ত্বশাসন, নতুন পতাকার সময় কাল মাত্র ২৪ বছর। নতুন ভূখণ্ড নতুন শাসনের স্থায়ীত্ব মাত্র সাড়ে তিন বছর। সিংহপুরুষ, বাঙালী জাতীয়তাবাদের একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধুকে কয়েকজন মেজর মিলে হত্যা করার ভেতর দিয়ে মাৎস্যন্যায় সমাজের পুনর্বিস্তার ঘটায়। এক মেজর থেকে অন্য জেনারেল এভাবে কেটেছে আরও ১৫ বছর। এই সময় পর্বে সমাজের বিভক্তি দূর করার উদ্যোগ খুবই দুর্বল অবস্থায় ছিল।
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ৯০ সালে নতুন পথ উন্মোচিত করেছিল এবং দেশের সব রাজনৈতিক শক্তি এক হয়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের অধীনে এক সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বিএনপি ও শেখ হাসিনার নেতৃতাধীন আওয়ামী লীগ যৌথভাবে ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন কায়েম হয়েছিল তা বাতিল করে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে।
মূল সংবিধানে যেমন প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা ছিল সেই ব্যবস্থাই ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু উচিত ছিল ক্ষমতা যৌথভাবে মন্ত্রীসভার উপর ন্যস্ত করা যেমনটি বলা আছে ভারতীয় সংবিধানে।
দেশ তথা সমাজে বহুবাদীত্বতা চর্চা করার সুযোগ আমরা হারিয়েছিলাম। সেই '৯০ সালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে যে সংলাপ সমঝোতা তৈরি হয়েছিল তা সমাজ গঠনের অত্যন্ত উপযোগী উপাদান ছিল। সংবিধানের প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা সেই সুযোগ নষ্ট হয়েছে। সেই সময়ের মাগুরা উপনির্বাচন দেশকে আবার বিভাজনের পথে ঠেলে দেয়। মাগুরা নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় তখনকার বিরোধীদলসমূহ ৯১ সালের নির্বচনে যে নির্বাচন ব্যবস্থার উপর আস্থা অর্জন করেছিল তা থেকে বেরিয়ে এসে, তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সব দল এক নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তাদের সেই আন্দোলন রাজপথের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলনের নাম ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন। তখন শাসক বিএনপি আলোচনার পথে সমাধানের পথ এড়িয়ে যাওয়ায়, বহুত্ববাদীতার আবার অপমৃত্যু ঘটে, যা আজও অব্যাহত আছে, আরও ব্যপক হয়েছে সমাজের রক্তরক্ষণ। নির্বাচনের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দেশের মানুষকে জিম্মি করে লাগাতার ধর্মঘট /আগুন বোমা/ বন্দুক যুদ্ধ/ সবই সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।
সামাজিক পুঁজি বৃদ্ধির জন্য বহুবাদীতার কোনো বিকল্প নাই। সামাজিক পুঁজি ছাড়া সমাজ গঠিত হয় না কিংবা স্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। সামাজিক পুঁজির অভাবের দেশে সবই সম্ভব। যেমনটা ঘটেছে এই দেশে। উদ্ধারকৃত মাদক পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে, আবার এই পুলিশই নিয়মিত মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে বন্দুকযুদ্ধ করে।
সামাজিক পুঁজির অভাবে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতাও ব্যাপকতা পায়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সব অংশ স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নাই, যে ধারা আজও অব্যাহত আছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক