যে কারণে দেশটির নাম ভারত
দেশটি তার জন্মকালীন নাম ধারণ করেছিল হিন্দু মিথোলজির শকুন্তলার ছেলে ভরতের নাম থেকে ভারত নামে। যদিও ভারতের সংবিধান রচনাকারীদের প্রধান দলিত নেতা ড. আম্বেদকার দেশটির নামকরণের প্রস্তাব করেছিলেন ইউনাইটেড স্টেট অফ ইন্ডিয়া, কিন্তু মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা নেতারা তা উড়িয়ে দেয়। মনের গভীরে হিন্দুত্ব লালনকারী সংবিধান রচনাকারী নেতারা সংসদে তা বাতিল করে ভারত নামকরণ করেন। কাশ্মিরী পন্ডিত, নেহেরু আর গান্ধী অনুসারীরা তখনকার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুজরাটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি বল্লবভাই প্যাটেলও ছিলেন ওই দলে, যারা ভারত নামকরণের পক্ষে ছিল।
১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার গর্ভ থেকে যে দুইটি দেশের জন্ম হলো তার একটি পাকিস্তান যার নেতাদের ঘোষণা ছিল দেশটি হবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। অন্যটির নাম হলো ভারত। রামের ছোট ভাইয়ের নাম ছিল ভরত, সেখান থেকে এ নাম। আর ভারতীয় সংবিধানে জন্মকালীন সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না। পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ ইন্ডিয়ার জনসংখ্যা ছিল ৩৯ কোটি। দুটি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের জনসংখ্যা হলো ১২ কোটি আর ভারতের ২৭ কোটি। এই ২৭ কোটির মধ্যে ছিল ৬ কোটি মুসলিম, এ ছাড়াও ছিল শিখ, জৈন আর খৃস্টান।
দেশটি জন্মকালীন যে নাম ধারণ করল তা ছিল হিন্দুত্বের গর্ভ থেকে আহরিত। সেই হিন্দুত্বের পথ ধরে গান্ধীর ভারত আর জিন্নাহর ইসলামি রিপাবলিক পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরী জনগণের ইচ্ছা যাচাই না করেই কাশ্মীরকে দখল করে। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর যখন কাশ্মীর নিয়ে প্রথম পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হয়, তখন পাকিস্তানের জিন্নাহ মরণব্যাধি যক্ষায় আক্রান্ত। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালে ভারতে নাথুরাম হত্যা করে বসে গান্ধীকে। নাথুরাম ছিল পশ্চিম বাংলার শ্যামা প্রসাদের দল আরএসএসের সদস্য।
নেহেরু প্যাটেলরা যে শুধু মুখেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলত, কিন্তু মনের গভীরে হিন্দুত্ব ধারণ করেছে তার প্রমাণ, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা শ্যামা প্রসাদের মন্ত্রী সভার সদস্য পদ লাভ। শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে এই আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা নেতাটি বলা যায় তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলা ভাগ করেছিল। গুজরাটি গান্ধী ও প্যাটেলরা আর কাশ্মীরী পন্ডিত নেহেরু বাংলা ও বাঙ্গালীকে দুই ভাগে খন্ডিত করে। বাঙ্গালী নতুন সংজ্ঞা পায়। 'বাঙ্গালী মুসলমান' আর 'বাঙ্গালী হিন্দু'।
ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া ভারত হওয়ার ভিতর দিয়ে যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পথ অনুসরণ করে ভারত তার গর্ভ থেকেই কাশ্মীর আর বাবরি মসজিদ সংকটের জন্ম দেয়।
কংগ্রেস জমানায় যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ইস্যু জন্ম নেয়, তখন মার্কিনীরা পাকিস্তানের পক্ষ নেয় চীনের সাথে বন্ধুত্ব পাওয়ার স্বার্থে। ইন্দিরা গান্ধী তখন সেই সময়কালের সোভিয়েতের সাথে এক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে, ফলে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত দ্বন্দে মার্কিনীরা তাদের সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করলেও যুদ্ধে হস্তক্ষেপ না করার ফলে পাক ভারত লড়াই সংক্ষিপ্ত রূপ ধারণ করে।
অটল বিহারী বাজপাইরা যখন বিজেপির উত্থানের রাস্তা খুঁজছিল তখন সোভিয়েত বিলুপ্ত হয়েছে। নতুন রাশিয়া নানান ক্ষেত্রে সক্ষমতায় মার্কিনীদের থেকে পিছিয়ে পড়ে। সোভিয়েত আমলের ভারতীয় অস্ত্র ভান্ডার ছিল সোভিয়েত আর সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোর। বিজেপি রাশিয়ার বন্ধুত্ব কখনও ভাল ভাবে গ্রহণ করেনি, কংগ্রেসের রাশিয়া সম্পৃক্ততার কারণে। মার্কিন বলয়ের অস্ত্রের প্রতি অনুরাগ ছিল ভারতীয় সেনা বাহিনী তথা বিজেপির। গত নির্বাচনের আগে কাশ্মীরের পুলওমারে সন্ত্রাসী হামলা আর চীনে লাদাখ সীমান্তর ঘটনায় বিজেপির পথ পরিস্কার হয়ে যায় অস্ত্র ক্রয়ের রাস্তায় হাঁটার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তথ্যমতে লক্ষ কোটির উপরে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পাদন করেছে বিজেপি সরকার।
পৃথিবী যখন ইতিহাসের ভয়ংকরতম শত্রু কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসের মুখামুখি, তখন নরেন্দ্র দমোদার দাস মোদী সরকার ব্যস্ত ঘন্টা বাজিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে আর রাম মন্দিরের ভূমি পূজার বাহারি প্রসাদ বণ্টন অনুষ্ঠান আর কাশ্মীরের আর্টিকেল ৩৭০ বাতিলের বর্ষপূর্তি উৎসবে।
মোদির পথ ধরেছ তুরস্কের প্রেসিড্ন্ট এরদোয়ান। প্রায় ১৭ শত বছরের বেশি সময়ের আয়া সুফিয়ার ইতিহাস নতুন ভাবে লিখতে, যা কিনা বিশ্বের বৃহৎ দুই ধর্মীয় জনগোষ্ঠিকে নতুন করে সংঘাতের রাস্তায় ঠেলে দিল। বাবরি মসজিদ/রাম জন্মভূমির বিতর্ক বহু শতাব্দীর, কিন্তু আয়া সুঁফিয়া নিয়ে তেমন বিতর্ক ছিল না। এরদোয়ান সেই বিতর্ক ঊস্কে দিল।
অযোধ্যার রাম জন্মভূমির মন্দির হওয়া আর তুরস্কের আয়া সুফিয়ার মসজিদ হওয়া দুটো বিষয়ই চূড়ান্ত করল বিচারপতিরা।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক