‘ভালো স্কোর’ করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অভিবাদন জানানো উচিত?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাপরিচালক (ডিজি হেলথ) পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দাবি করেছেন, করোনাভাইরাস মহামারি সামলানোয় 'ভালো স্কোর' অর্জন করেছে তার মন্ত্রণালয়।
কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা কেলেংকারির মধ্যেও, ডিজি হেলথ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের পদত্যাগ যেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছে। কোভিড-১৯-এর ভুয়া টেস্ট সার্টিফিকেট জারি করার দায়ে অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবন্ধ হওয়ার দায় 'বেকুবের মতো' স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়েছিলেন অধ্যাপক আজাদ।
বিতর্কিত রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে তার বিভাগ চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপরমহলের নির্দেশনাতেই- জনগণকে এ কথা বলে ওই কেলেংকারি দায় মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপানোর 'উদ্ধত' চেষ্টা করেছিলেন ডিজি হেলথ।
এমনকি তিনি তখন স্বাস্থ্য সচিবের নামও বলেছিলেন, যিনি নাকি জুলাইয়ের শুরুতে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আজাদের সঙ্গে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।
তবে ওই চুক্তির দায়ভার নিজ কাঁধে নিতে মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় নারাজ। কেলেংকারিটির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে; তার উপস্থিতিতে হওয়া ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের ছবি হয়ে গেছে ভাইরাল।
এত বড় ধরনের কেলেংকারির পর, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগ অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই একটা বেশ পুরনো রেওয়াজ। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন বেশ কিছু মন্ত্রী।
তাই কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার ওই কেলেংকারি একটা বড় প্রশ্ন সামনে এনেছিল: কে করবেন পদত্যাগ?
অবশেষে বলির পাঁঠা হলেন ডিজি হেলথ। তার ওই পদত্যাগের অর্থ হলো, নিজের 'চাকরি' টিকিয়ে রাখতে সফল হলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এটি তার নিজের ও তার মন্ত্রণালয়ের জন্য একটা ভালো স্কোর।
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের ভালো স্কোর হিসেবে আরও যে দুটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন, সেগুলো ধোপে টেকার মতো নয়। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড-১৯-এ মৃত্যুহার কম হওয়াটা এখনো এক রহস্য। অনেকের মতে, এ অঞ্চলের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তরুণ হওয়াই মৃত্যুহার কম হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে এর কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটিকে নিজেদের কৃতিত্ব বলে দাবি করতে পারে না।
নিজ মন্ত্রণালয়ের সাফল্য হিসেবে অন্য যে পয়েন্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, সেটি হলো- কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে সিট খালি থাকা। তার দাবি, সিট খালি থাকাই প্রমাণ করে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সফল।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এরইমধ্যে এর উল্টো কথা বলছেন। নমুনা পরীক্ষা কেলেংকারি জনমনে স্বাস্থসেবা খাতের প্রতি আস্থা নষ্ট করেছে। মানুষ ভর্তি হতে আগ্রহী নয় বলেই হাসপাতালগুলোতে শয্যা খালি পড়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা নিয়ে কেলেংকারির কারণে মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ায় দৈনন্দিন পরীক্ষার সংখ্যা কমছে, একইসঙ্গে ভাইরাসটির বাঁক সরলরৈখিক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর ক্ষেত্রে নিজের অধিদপ্তরের নড়বড়ে পারফরম্যান্সের জন্য অধ্যাপক আজাদ যেখানে সমালোচিত হচ্ছিলেন, অবশেষে তিনি পদ থেকে সরলেন, এবার হয়তো তাকে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থার মুখে ফেলা হবে। এটি আমাদের সরকারি নিয়মের চিরচেনা নকশা।
আরেকটি বিতর্কিত স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেকেজি'কে কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা করার চুক্তিতে স্বাক্ষরের দায়ও অধ্যাপক আজাদের কাঁধে পড়েছে। তার সহকর্মী, সহকারী মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বুধবার পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) বলেছেন, জেকেজি কেলেংকারির শুরু থেকেই ডা. আজাদ সম্পৃক্ত।
ধরে নেওয়া যাক, রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা কেলেংকারিসহ স্বাস্থ্য খাতের সব অনিয়মের দায়ভার অধ্যাপক আজাদের।
করোনাভাইরাস মহামারি সামলানোর বেলায় স্বাস্থ্য খাতের নড়বড়ে পারফরম্যান্সের দায়ভারও তার। এই খাতের বর্ধমান দুর্নীতি- যা নিয়ে বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে- দুর্নীতি ও মহাপরিচালকের নেতৃত্বাধীন থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে রয়েছে বন্ধন।
তার মানে, মহাপরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার ফলে এই খাতের সকল দীর্ঘস্থায়ী সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া যাক। কিন্তু তা তো ঘটবে না; কেননা, পচন তো ছড়িয়ে রয়েছে শেকড়ে। স্বাস্থ্য খাতের সকল ভালো ও মন্দ কাজের দায়ভারের সর্বময় নেতৃত্বে তো স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক নন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ। মন্ত্রণালয়ের তদারকির অধীনে স্বাস্থ্য খাতের মাঠ পর্যায়কে পরিচালনা করে স্বাস্থ্য বিভাগ।
বিতর্কিত রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে, তাদেরকে কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা করতে দেওয়ার মতো এতসব অপকর্ম স্বাস্থ্য মহাপরিচালক যখন করছিলেন, তখন মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় কী করেছে?
এর সম্ভাব্য উত্তর দুটি। হয় এই সমস্ত অপকর্ম সম্পর্কে মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের জানা ছিল না; নয়তো জানা থাকলেও নিজ নিজ দায়ভার এড়াতে নিশ্চুপ থেকেছেন।
যদি তারা অপকর্মগুলো সম্পর্কে না-ই জানতেন, তাহলে সেটি তো তাদের তদারকি ভূমিকা পালনের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। নিজ দায়ভার তারা অবহেলা করেছেন।
যদি তারা এইসব অপকর্মের ব্যাপারে জানতেন, তাহলে সেই হুমকির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে তাদের ব্যর্থ হওয়া পক্ষান্তরে অপকর্মগুলোকে সমর্থন করাই সামিল।
উভয় ক্ষেত্রেই, নমুনা পরীক্ষা কেলেংকারি এবং স্বাস্থ্য খাতের নৈরাজ্যের দায়ভার তারা এড়াতে পারেন না। চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার দায়ে জুনে মন্ত্রণালয়কে সমান দায়ি করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে সংগঠনটি বলেছে, নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ, কারিগরি ত্রুটিযুক্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও চিকিৎসকদের অপ্রতুল প্রশিক্ষণব্যবস্থা ভাইরাসটিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ি।
এই নমুনা পরীক্ষা কেলেংকারি স্বাস্থ্য খাতের ভঙুর পরিচালনা ব্যবস্থা আরও একবার দেখিয়ে দিলো।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কার্যপরিচালনা নজরদারি করার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোনোকিছু ঠিকমতো না চললে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকার কিংবা এর কোনো বিভাগকে নির্দেশ দেয় সংসদ। এই ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের সংসদ ও এর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটি স্বাস্থ্যসেবা খাতের পারফরম্যান্ত তদারকিতে ভূমিকা রাখার দায়িত্বটি পালন করেনি।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের কেলেংকারি ও সংকটটি দেখিয়ে দিয়েছে এই খাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের নাজুক অবস্থা। এটি সামগ্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রেরই একটি অংশ।
তবু কি আমরা আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অভিবাদন জানাতে পারি কোভিড-১৯ মহামারি সমালানোয় তার মন্ত্রণালয়ের 'ভালো স্কোর' করার যে দাবি তিনি করেছেন, সেজন্য? মহামারির এ কালে ভালো খবর বিরল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি 'ভালো খবর' দিয়ে থাকেন, তাকে আমাদের অভিবাদন জানানো উচিত। যদি তাকে আমরা অভিবাদন জানাতে চাই, তাহলে বাস্তবতার নিরিখে তার দাবি পরীক্ষা করা ঠিক হবে না।
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
মূল লেখা: Should we congratulate our health minister for earning 'good scores?'