“প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবি ঠাকুর মূর্তি গড়া”
কবীর সুমন আমার শহরে এসেছেন। কিন্তু তাকে আমি দেখিনি। দেখা হবে কিনা তাও জানিনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার সঙ্গে একবার সামনাসামনি দেখা হওয়া দরকার ছিল। তাকে আমি বলতে চাই যে আমরা যারা সক্রিয় রাজনীতি করিনি, বা ছাত্র রাজনীতি যখন থেকে গর্হিত বলে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে, যখন আমরা জীবনাদর্শের নানান সংকটের মধ্য দিয়ে কৈশোর থেকে অ্যাডাল্টহুডের দিকে যাচ্ছি, সেই সময়ের একজন অসামান্য দিকনির্দেশক হিসেবে সুমন আবির্ভূত হলেন আমাদের জগতে। এক-একটা কম্পাসের মত তার একেকটা গান দেখিয়ে চলল জীবনের এমন সব অজানা দিক, এমন সব উপলব্ধির ঠিকানা, যা কোন স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু, প্রেমিক, পছন্দের লেখক, বই– কেউই এত স্পষ্ট করে দেখায়নি।
একটা সময়কে ডিফাইন করেছেন সুমন। নানান রকম বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে, বন্ধুত্বের বন্ধন গাঢ় হয়েছে তার গানকে অবলম্বন করে। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় প্রয়োজন আর কী আছে! "যৌথ খামার" নামে একটা ব্যান্ডও তৈরি হলো আমাদের ১৯৯৯/২০০০ সালে। এ পর্যন্ত এই ব্যান্ড যদিও কোন শো করেনি, করবে নিশ্চয়ই। যাক গে, সে আলাদা কথা!
১৯৯৮-এ হোটেল শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে আর জাতীয় জাদুঘরে দুইটা শো দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রথম শো-তে গিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে, আর দ্বিতীয় শো-তে পরিবারের অনেকে। দুইদিনের স্মৃতিই প্রাঞ্জল হয়ে আছে। জাদুঘরের শো-তে সুমন যখন গেয়ে উঠলেন "বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান/ তীরের ফলায় তবু বিষ নয় লালনের গান/ সে-গানে বিদ্ধ বুক রক্তে অশ্রু ছলোছলো/ এ যদি আমার দেশ না-হয় তো কার দেশ বলো? – সুমন সেই মুহূর্তে আমাদের হয়ে উঠলেন আরও একটু বেশি। সেই বয়সে জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনেক বেশি আবিষ্ট ছিলাম নিশ্চয়ই! গাইলেন কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে তার অনবদ্য গান– "ঐ তো লক্ষ ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি দামাল/ সবুজ দ্বীপের মত মাঝখানে সুফিয়া কামাল"। আর গানের ফাঁকেফাঁকে তার স্বভাবসিদ্ধ আদিঅন্তহীন গল্পের ঝুলি! শেষ করলেন হলের সবাইকে নিয়ে "পুরানো সেই দিনের কথা" গেয়ে। আমি নিশ্চিত যে হলে বসে থাকা কেউ সেদিন না কেঁদে বাড়ি ফেরেনি।
এরপর ২৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধনগুলি শিথিল হয়েছে, নানান দায়িত্বভার আমাদের উদ্দীপনাকে প্রশমিত করেছে, "রাস্তায় পড়ে [থাকা] স্বপ্নের লাশ" দেখতে দেখতে নতুন স্বপ্ন আমরা এখন আর প্রায় দেখিই না। কিন্তু আমরা যারা নব্বই দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তাদের একটা বিশাল অংশের বুকে সুমন একেকটা কম্পাস এঁকে দিয়েছেন। ক্লাসের ফাঁকে শ্রাবন্তী বা অনিন্দ্য গেয়ে উঠত "ছেঁড়া তালপাতা পুঁথির পাতায় নিঃশ্বাস ফেলে হাওয়া, এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া"। ২০০৮-এ এসেছিলেন যখন, তখনও গিয়েছি তার গান শুনতে। নানান কারণে সেবার হতাশ হয়েছিলাম– কোথাও যেন সুমন নিজেকে হারিয়ে জবরদস্তি কিছু একটা হতে চাইছিলেন– এমন মনে হয়েছিল। এবার আর হতাশ হওয়ার ঝুঁকি নিতে সাহস করিনি, তাই বন্ধুদের অনেক ডাকাডাকিতেও সাড়া দিইনি। কিন্তু সুমন আছেন আমার শহরে, গান গাইছেন, এটা জেনে তাকে না দেখে ফেরার অস্থিরতাকেও অস্বীকার করার জো নাই! আবার মনে হচ্ছে আমি যে সিটটা ছেড়ে দিয়েছি সেখানে হয়তো ২০২২-এ বসেছেন এক স্বপ্নবাজ দিকহারা তরুণী। তাকেও নিশ্চয়ই সুমন দিতে পেরেছেন কোন একটা ভাবনার হাতছানি– এমন কোন উপলব্ধি যা মেয়েটির স্বপ্নকে নোঙর করার সাহস যোগাবে। বিশ্বাসহীন ধূসর এই সময়ে এটাই তো দরকার।
দায়িত্বভারে অবনত আমারও হয়তো একবার দরকার ছিল সুমনকে এই সময়ে সামনে বসে শুনবার। জানিনা তিনি গেয়েছিলেন কিনা "আজকে যে শিস দিয়ে গান গায়, কোন গান শুনবে হে কাল সে/ চোখ থেকে খুলে নেবে চশমা, ভুলে যাবে চোখে আছে চালশে... ", কিংবা "পালটে দেবার স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলো না, দিনবদলের স্বপ্ন আমার এখনও গেল না..."
সুমনের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নাই। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, আব্বাসউদ্দীন যে কাতারে, প্রভাবের দিক থেকে সুমন তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তার পদধূলি একবার না নিলে আমার ব্যক্তিগত ঋণস্বীকার অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই এবেলা তার সাথে দেখা না হলেও তাকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অভিনন্দন জানাই, আর জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
কবীর সুমন তার গান আর অঢেল গল্পের সম্ভার নিয়ে আরও অজস্র অনাগত প্রজন্মের জন্য ধ্রুবতারা হয়ে থাকুন।
- লেখক: ইউপিএল প্রকাশনার পরিচালক