পুতিনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কি গ্রহণযোগ্যতা রাখতে পারলো!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর পরই ১৯৪৬ সালের মে মাসে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামক একটি আন্তর্জাতিক আদালতের জন্ম হতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারের কাছ থেকে এসেছিল সেই ঘোষণা। ১৯৪৬ সাল থেকে নিয়ে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই আদালত টোকিও ট্রায়াল নামে খ্যাতি লাভ করে। ১৩ জন বিচারপতিকে নিয়ে এই আদালত গঠিত হয়, যেখানে মার্কিন বিচারপতি ছিলেন এবং ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে চীন ও তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া থেকেও একজন বিচারপতি।
ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া থেকে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতির জন্ম পূর্ব বাংলার কুষ্টিয়া জেলায়। তার নাম রাধা বিনোদ পাল। সেই টোকিও ট্রায়ালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, কাউকে দেওয়া হয়েছিল কারাগারের সাজা। কিন্তু, রাধা বিনোদ পাল টোকিও ট্রায়ালে তার ভিন্নমতের রায়ের জন্য পৃথিবীর কাছে আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি জাপানে মার্কিনীদের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপকে মিত্রশক্তির একটি অপরাধ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ওই আদালতের প্রধান ছিলেন একজন মার্কিন বিচারপতি।
প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিলুপ্তির প্রায় ৫২ বছর পরে রোমে জাতিসংঘের উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠনের সম্মেলন হয়, যা রোম স্ট্যাটিউট নামে খ্যাত। রোম স্ট্যাটিউটে পৃথিবীর ১২৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে এবং মজার বিষয় হল, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেনি। চীন ও রাশিয়াও নেই এ আদালতে। অবাক করা ব্যাপার হলো, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে টোকিও ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছিল রোমে, মার্কিনীরা তাতে যোগ দিল না। যোগদান না করার কারণ হিসেবে তাদের ব্যাখ্যা ছিল- মার্কিন সংবিধান এটা অনুমোদন করে না; অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের বিচার কেবলমাত্র তাদের বিচার ব্যবস্থাই করতে পারবে, অন্য কোনো আদালত নয়। যদিও টোকিও ট্রায়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোনীত বিচারকই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়বার গঠিত অপরাধ ট্রাইবুনালে (আইসিসি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যোগ না দিলেও যে দেশগুলোর নেতৃত্বে বিচারকার্য চলছে, তারা প্রায় সবাই মার্কিনীদের অনুসারী। উল্লেখ করতে হয়, ইউরোপের যে কয়জন বিচারপতি মনোনীত হয়েছেন এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, তারা সবাই ন্যাটোভুক্ত দেশের নাগরিক; এর বাইরে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকরা আছেন। মোট ১৮ জন বিচারপতি যাদের বিচারকাল ৯ বছর।
এই ট্রাইবুনালের সদস্য ইউক্রেন। সে কারণে ইউক্রেনে সংঘটিত যেকোনো অপরাধ এই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত জানিয়ে আইসিসি পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলকৃত এলাকাতে শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে এই হলো অভিযোগ।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় পুতিনের সঙ্গে আরেকজনকে আসামি করা হয়েছে। তিনি হলেন, মারিয়া লোভোবা-বেলোভা। তিনি পুতিনের সহকর্মী হিসেবে ক্রেমলিনে কর্মরত।
এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ইসরায়েলও সদস্য হয়নি, কিংবা মিয়ানমারও এর সদস্য নয়। এর সদস্য হলো ভারত। এই অপরাধ ট্রাইবুনালটি গঠিত হওয়ার পরে ফিলিস্তিনে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, সেখানে খোদ ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট বেশকিছু ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র দেখতে পেয়েছেন। এরমধ্যে একটি ছিল 'টার্গেটেড ফায়ার', যা পরে ইসরায়েলের আদালত নিষিদ্ধ করে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন এই আদালতের দ্বারে দ্বারে বিচারের জন্য ঘুরছে। অধিকৃত কাশ্মীর, সিরিয়ায় ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো কোনো কিছুই তাদের নজরে আসেনি। অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড জোর করে দখল করে বসতি স্থাপন করেছে ইসরায়েল। এই আদালত গঠনের পূর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে ইরাকে যুদ্ধের কথা আমাদের মনে আছে। প্রেসিডেন্ট বুশ এবং যুক্তরাজ্যের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সারা বিশ্বকে বুঝিয়েছিলেন ইরাক মানবতাবিরোধী অস্ত্র সংগ্রহ করছে, যা মানবসমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এমন তথ্য হাজির করে ইরাক দখল করে ইরাকের তেল ভাণ্ডার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দেশটিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। বহু বছর যাবত ইরাক থেকে তেল লুণ্ঠন করেছে- এই দুই দেশের তেল কোম্পানিগুলো। শেষপর্যন্ত টনি ব্লেয়ারকে তার নিজ দেশেই এক ইন্ডিমনিটি গ্রহণ করতে হয়েছে ইরাক যুদ্ধের দায়ভার নিয়ে। অথচ এই আন্তর্জাতিক আদালত পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটা স্বীকৃত অপরাধকে গুরুত্ব দেয় না, গুরুত্ব পায় কেবল মার্কিন নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি।
ইউক্রেনের যে দুইটি অংশকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পুতিন স্বীকৃতি দিয়েছেন, সে অংশ দুটির জনগণ কী চায়- তার কোনো গুরুত্ব নেই তথাকথিত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজের কাছে। তারা পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। আবার ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো।
অদ্ভূত এক মুদ্রা ব্যবস্থায় পৃথিবীর তাবদ মুদ্রা যখন মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে- তখন খোদ যুক্তরাস্ত্রেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঘটনা ঘটছে। আমেরিকার নিজের আর্থিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার শর্তেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ চলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির মতো একটি ঘটনাও প্রয়োজন ছিল মার্কিনীদের। মূলত এই যুদ্ধকে আরো জটিল রূপ দেওয়ার লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক আদালতটি এই একপেশে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।