বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ: আরেকটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিস্মৃত গল্প
একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। বায়ান্নর এই দিনে ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পূর্ব বাংলার তরুণেরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন, যার ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রবাসী বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের নেতৃত্বে 'মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অভ দি ওয়ার্ল্ড' গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। তাদের উৎসাহে এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ও সার্বিক সহযোগিতায় এই দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
তবে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলাভাষী জনগণের আরও একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
১৯৬১ সালে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বিশ্বের প্রথম নারী কমলা ভট্টাচার্যসহ সেদিন প্রাণ দেন মোট ১১ জন। তারপর থেকে বাংলা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।
মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। একসময়কার সাঁওতাল পরগণার জঙ্গলমহলের মানভূম জেলা প্রচুর বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহারের অধীন থেকে সরিয়ে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে।
আসামের বরাক উপত্যকায় অবস্থিত কাছাড় জেলা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠী কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে চলে গেলে আসাম ও নেফা (নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি)-এর একাংশ সিলেটের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও আসামের কাছাড়ের পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়।
এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও) — এই চার পরিবর্তিত জেলায় রূপ নিয়েছে। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। বাঙালিরা সেখানে বহিরাগত — এমন বক্তব্য তৈরি হতে থাকে। প্রবল জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদেরাও গা ভাসান। সূচনা হয় বঙ্গাল খেদা আন্দোলনের।
সরকারিভাবে সেসব সহিংসতা দমন করা হলেও পরবর্তীকালেও সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। আসাম রাজ্য বিধানসভায় ১৯৪৭-এর শুরুতে অহমিয়া নন এমন সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন। প্রথম আঘাত এলো ভাষার ওপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙালি জনগণ — বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী বরাক উপত্যকার অধিবাসীগণ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকেন।
দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির জাত্যভিমান আহত হয় এবং তারা মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হন। আসাম রাজ্যসরকার সমঝোতার পথে না গিয়ে অহমিয়া জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে বাঙালিদের আন্দোলনও ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকে। নিশ্চয়ই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধানসভায় ভাষা বিল পাশ হয়। এর মাধ্যমে যেন কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেল। বাঙালিরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকল। সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো, সংকল্প দিবস ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা।
এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হতে শুরু করেন। হাজার-হাজার ছাত্র, যুবা, জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গণ ও রেললাইনের ওপর অবস্থান নেন। তাদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্যসহ মোট ১১ জন ছাত্র-যুবা। তারাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার — যা পরবর্তীসময়ে সমগ্র বরাক উপত্যকার অন্য অনেক স্থানেও নির্মাণ করা হয়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পালটে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও তার পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও মেলেনি।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এই আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। বরাক উপত্যকায় একাদশ শহীদ অনন্য সন্মানে ভূষিত। কিন্তু সব এলাকার বাঙালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারনা রাখেন? উত্তরটি কিন্তু না সূচক।
আমাদের কর্তব্য তাদের আত্মত্যাগের কাহিনি সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে।
বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে।
বাংলাসহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।