বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু পুরনো বই সম্প্রতি (আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে) পুনঃমুদ্রণ হয়েছে। বইগুলো বেশ পুরনো। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বইগুলো বাজার কাটতি। ড. ইউনূস সম্পর্কে আগ্রহীরা বইগুলো কিনছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে দেশে। শাসনব্যবস্থার বদল হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য জুলাই-আগস্ট ছিল একটি ঝোড়ো সময়। একদিকে রাজপথ ছিল জনতার দখলে, আরেকদিকে চলছে আশঙ্কা। কমবেশি সবাই রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিতর্কে জড়িয়েছেন। এখন রাজনৈতিক বিতর্ক আর আড্ডার খোরাক জোগায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুল প্রসারের কারণে বই পড়ার অভ্যাস কমেছে বলা হয়। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা।
শুধু ড. ইউনূস নন, আগস্টজুড়ে বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আলী রীয়াজ, আলতাফ পারভেজ, শাহাদুজ্জামান, ফরহাদ মজহার, সুহান রিজওয়ান, পিনাকী ভট্টাচার্য, এম সাখাওয়াত হোসেন, আনু মুহাম্মদ, আসিফ নজরুল ও মহিউদ্দিন আহমেদের মতো সক্রিয় লেখক গবেষকদের বই। বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সময়ও বটে।
দেশের মননশীল ও গবেষণাধর্মী পুস্তক মুদ্রণশিল্পের অন্যতম সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স লিমিটেডের (ইউপিএল)। ইউপিএলের কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিন সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখেছেন- বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে এমন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন এবং এজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকা দরকার। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আর না থাকার পেছনে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। সরকারি অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় অ্যাকাডেমিক গবেষণা ও প্রকাশনার উদ্যোগ নিতে হবে।
৩১শে আগস্ট তিনি দ্য ডেইলি স্টারে ইট ইজ টাইম টু রিফর্ম দ্য পাবলিশিং সেক্টর শিরোনামে এক কলামে তিনি লিখেন- অতীতের শাসনামলে এমন বইগুলোয় বিনিয়োগ ছিল, যেগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী পরিবেশন করেছিল, একটি নির্দিষ্ট আখ্যান ও বয়ান হয়ে উঠেছিল কণ্ঠস্বর। প্রকাশনাগুলোও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়েছিল। বেশিরভাগ সরকারি প্রকল্পের বই অধিগ্রহণ প্রাথমিকভাবে কিছু লেখক, আমলা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পক্ষে করা হয়েছিল যারা রাতারাতি সর্বাধিক বিক্রিত লেখক হয়ে ওঠেন। কারণ, তাদের বইগুলো বড় সরকারি কেনাকাটার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। (অনুবাদ- লেখক)।
ইউপিএল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ইতিহাসধর্মী গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা। গুণগত বিচারে এ প্রকাশনীর বইগুলো সিরিয়াস টেক্সট হিসেবে নেওয়া যায়।
মাহরুখ লিখেছেন- 'আমরা আশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকৃত রাষ্ট্রের ভিত্তি পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, যা তার রাষ্ট্র-সংস্কার এজেন্ডার কেন্দ্রে জ্ঞান উৎপাদন ও প্রসারে শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করবে। এটি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় হবে প্রকাশনা খাতকে গ্রাউন্ড আপ থেকে সংস্কার করা। নিশ্চিন্ত থাকুন, তারা এই অত্যাবশ্যকীয় এবং অতি-প্রয়োজনীয় পরিবর্তনকে অনুঘটক করার জন্য এ বাণিজ্যে সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রতিভাবান ব্যক্তিদের তরুণ এবং দেশপ্রেমিক শক্তির উপর নির্ভর করতে পারে। (অনুবাদ- লেখক)।
মাহরুখের কথাগুলো আমলে নেওয়ার মতো। রাজনৈতিক ইতিহাসকে দলীয় বলয়ে বন্দী না করে তিনি স্বাধীন প্রকাশনা ও গবেষণা শিল্পে মন দিতে বলেছেন সরকারকে।
বই মানসিক চাপ কমানোর দারুণ একটি উপায়। আমরা একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছি। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস যাদের, তাদের এখন সময় কাটছে বইয়ের সাথেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে বইয়ের বিক্রি ও প্রচারণা। বিভিন্ন প্রকাশনী ফেসবুক পেইজে রাজনৈতিক ইতিহাস ও সমসাময়িক পরিস্থিতির ওপর কিছু বইকে প্রামোশন করছেন। প্রতিদিনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা মানুষের জন্য বই হতে পারে মানসিক চাপমুক্তির একটি পথ। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের সঙ্গে মানুষে আন্তঃসংযোগ বেড়েছে।
বইয়ের দোকান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলছে, রাজনৈতিক তুফানের মধ্যেই সম্প্রতি বেড়েছে বই পড়ার আগ্রহ। দেশের রাজনীতিতে পালাবদলের ফলে অজানা ইতিহাস জানতে চলছে জমজমাট বই পড়া ও পুরাতন নতুন বইয়ের ব্যবসা। নতুন ও পুরাতন প্রজন্ম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা বয়ানের খোঁজে সন্ধান করছে নানা ধরনের বই। চট্টগ্রামের মননশীল পুস্তক বিপণিকেন্দ্র বাতিঘর। মধ্য আগস্টের পরপরই এখানে বেড়েছে রাজনৈতিক ইতিহাসধর্মী বইয়ের বিকিকিনি।
গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়ে অনেকগুলো নতুন বই এসেছে বাতিঘরে। বইগুলোতে রয়েছে সময়কে ইতিহাসের প্রয়োজনে মলাটবন্দী করার আয়োজন। আবার কোনো কোনো বইয়ে ইতিহাসকে নতুন আলোয় তুলে আনার প্রয়াস রয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি ও বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের চিন্তামূলক লেখার সংকলন যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু গবেষণামূলক গ্রন্থও।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাতিঘরের ক্যাশ কাউন্টার থেকে নিয়মিত বই বিক্রির পাশাপাশি ফোনে ও অনলাইনে বই অর্ডার বেড়েছে, যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক ইতিহাসের। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগে সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বই। তখন অনেকেরই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস ছিল। অথচ, বর্তমানে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, বই পড়ার বিষয়টি খুব কমই চিন্তা করি। তাই সাম্প্রতিক বাংলাদেশকে বোঝার জন্য রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু বইয়ের প্রতি জোর দিতে চাই। এই সময়ে এসে রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ ও চর্চার কিছু জরুরি বই আমাদের পড়া দরকার।
আন্দোলন সংগ্রাম ও সহিংসতায় ভরা এই দেশের অতীত জানতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে এমন একটি বইয়ে যা সংঘাতের রাজনৈতিক উৎসকে তুলে ধরে। 'সংঘাতময় বাংলাদেশ অতীত থেকে বর্তমান' (মো. বদরুল আলম খান) তেমনিই একটি বই। যদিও বর্তমানে বইটির মুদ্রিত কপি নেই।
এদিকে মুহাম্মদ ইউনূসের চিন্তা ও লেখা সম্পর্কে জানতে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে তার কিছু বইয়ে। সামাজিক ব্যবসা, পথের বাধা সরিয়ে নিন, মানুষকে এগুতে দিন বইগুলো তার চিন্তা ও তৎপরতাকে তুলে ধরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এগুলো আগস্ট (২০২৪) মাসে পুনঃমুদ্রিত হয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের তিনটি বই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো- ইতিহাসের দোলাচল: বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, নিখোঁজ গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি সমাজ ও ব্যক্তিজীবন।
আলী রীয়াজ তার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দোলাচল: বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বইতে লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির গত ৫০ বছরের পথপরিক্রমা একরৈখিক নয়, ঘটনাবহুল ও বন্ধুর; আছে উত্থান ও পতন। এই ঘটনাপ্রবাহের ভেতরে যেসব প্রবণতা এবং নাগরিকদের যে আকাঙ্ক্ষাগুলো অপরিবর্তিত থেকে গেছে সেসব চিহ্নিত করেছেন তিনি। ইতিহাস আলোচনার প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে।
আলী রীয়াজের আরেকটি বই এই সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক সেটি হলো- লুণ্ঠিত ভবিষ্যৎ। যেখানে সম্পাদক আলী রীয়াজসহ একাধিক লেখক ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিছু অমোঘ সতর্কবাণী করেছিলেন। বইটি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যতে অর্থনীতির অবস্থান কি রকম হতে পারে তার একটি গবেষণাধর্মী পাঠ। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির ছত্রছায়ায় দেশের অর্থ বিদেশে পাচার এবং রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের বর্ণনা আছে এতে।
আগামী দিনের অর্থনীতি যে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে, তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী এই বইতে উল্লেখ রয়েছে। সাবেক শাসকের অর্থনৈতিক সংকটের স্বরূপ—বিশেষ করে ব্যাংক, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের লাগামহীন দুর্নীতি, অপচয় এবং বিপুল অর্থ পাচারের চিত্র তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ের নিবন্ধগুলোতে। ব্যাখ্যা করা হয়েছে এর সঙ্গে সুশাসনের অভাবের সম্পর্কও। সংকটের গভীরতা ও ভবিষ্যতের বিপদ বুঝতে এই বই পাঠ জরুরি।
এছাড়াও আগস্টেই বাজারে এসেছে লেখক মহিউদ্দিন আহমেদের নতুন বই 'জামায়াতে ইসলামী: উত্থান বিপর্যয় ও পুনরুত্থান'। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিকে বুঝতে হলে আমাদের এই বিপুল শ্রমসাধ্য কাজটিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
সাম্প্রতিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থানকে বুঝতে গেলে আরেকটি বই আমাদের অবশ্য পাঠ্য, সেটি হলো অনুপম দেবাশীষ রায়ের লেখা কালকের আন্দোলন আজকের আন্দোলন। বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলনের আগে ও পরের আন্দোলনগুলার রূপ ও গতি কীভাবে বদলিয়েছে, কতটা সফল হয়েছে বা হয়নি থেকে শুরু করে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট–সবকিছুর কথা এ বইটিতে আছে।
এই বইয়ের মূল আলোচ্য– শাহবাগ গণজাগরণ, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নো-ভ্যাট মুভমেন্ট ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনগুলো। বইটিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রচলিত গণআন্দোলন কিভাবে ডিজিটাল চরিত্র পেয়েছে এবং প্রথাগত চরিত্র বদল করেছে! বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য, রাজনৈতিক প্রবণতা অনুসন্ধানের জন্য, তরুণ প্রজন্ম বা জেন-জি এর নেতৃত্বে আন্দোলনগুলো নিয়ে সমাজে এর প্রভাব বুঝতে এই বিশ্লেষণ অবশ্যই আমাদের মনোযোগ দিয়ে পড়া দরকার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠের খোঁজ নিয়ে জানলাম কিছু বই পাঠক মহলে খুব আলোচিত। যেমন- লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি, প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বিএনপি সময়-অসময়, বেলা অবেলা, জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি (মহিউদ্দিন আহমদ), স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ (পিনাকী ভট্টাচার্য), মূলধারা ৭১ (মইদুল হাসান), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, র এবং সিআইএ (মাসুদুল হক), মুজিববাহিনী থেকে গণবাহিনীঃ ইতিহাসের পুনর্পাঠ (আলতাফ পারভেজ), আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর (আবুল মনসুর আহমদ), শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল (মওদুদ আহমদ), শতাব্দী পেরিয়ে (হায়দার আকবর খান রনো), বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ (বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন), বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ (অ্যানথনি মাসকারেনহাস- অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান) এবং বাঙলাদেশের অভ্যুদয় (বদরুদ্দিন উমর) দুটি খণ্ড ইতিহাস হিসেবে অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি বই পড়তে গিয়ে কাকতালীয় একটি ব্যাপার চোখে পড়ল। দেশের রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহারের সর্বশেষ বইয়ের নাম গণভ্যুত্থান ও গঠন। রাষ্ট্রচিন্তা থেকে প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চায় একটি নতুন প্রকাশনা। বইটি পড়ার শুরুতেই খেয়াল করি- বইটির ভূমিকা লেখা হয়েছে ৫ই আগস্ট ২০২৩। পাঠক হিসেবে কৌতুহলী মন চলে যায় ওই তারিখটিতে। ঠিক এক বছর পরে যে তারিখে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হলো! বইটি ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কারো কারো পাঠ্য ছিলো বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানা গেছে।
একটি সহিংস জনযুদ্ধের মধ্যে স্বাধীন হওয়া জাতি আমরা। জাতির ইতিহাস অনুসন্ধানে বই আমাদের পড়তেই হবে। এই ভূখণ্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশ জানতে রাজনৈতিক ইতিহাসধর্মী বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের দিন ৫ই আগস্ট ফেসবুকে দেখেছি দুটো বইয়ের দুটো পৃষ্ঠা 'ভাইরাল' হতে। একটি হলো শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল, আরেকটি জহির রায়হানের আরেক ফাগুন। ক্রাচের কর্নেল বইটির যে বাক্যটি ভাইরাল হয়, তাতে লেখা আছে- মর্মাহত তাহের ঘরে গিয়ে লুৎফাকে বলেন: কেবল স্বাধীন হলো একটি দেশ, কীভাবে লুটপাট শুরু হয়ে গেল দেখ। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অরাজক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ে যায় শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল বইয়ের লুৎফা ও তাহেরের সংলাপে। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে তাহেরের আক্ষেপ দেখে আমরা এখন বুঝি, চলতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে অরাজক অবস্থাটা নতুন কোনো দৃশ্যায়ন নয়।
এদিকে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে তীব্র আন্দোলনে বসে দেখতে পাই জহির রায়হানের আরেক ফাগুনের একটি বাক্য- আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব। জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের গল্প। ভাষা আন্দোলনকারীদের জেলখানায় ঢোকানোর সময় নাম ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়!' জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে। ও কথা শুনে একজন বললেন, 'এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।
এভাবেই দেখেছি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাঁক বদলে বই, বিশেষত রাজনৈতিক ইতিহাস ও বিশ্লেষণধর্মী বই হয়ে উঠেছে আলোচনার বিষয় হিসেবে। যোগাযোগবিদ্যার সাবেক শিক্ষার্থী বা সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে আমার আগ্রহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ। এ লক্ষ্যে ছাত্র জীবন থেকেই আমি গত ২৫ বছর ধরে নিজের ঘরে সুপরিসর লাইব্রেরি গড়ে তুলেছি। এতে ভিন্নমতের বইয়ের পাশাপাশি নানান একাডেমিক বইও রয়েছে।
বইপড়ার প্রতি জোর দিয়ে এই লেখার শেষে আমি স্মরণ করতে চাই অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। যিনি বলেছেন- বই মেলায় গেলে পাশাপাশি সাজানো বইয়ের দিকে তাকালে বইমেলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ার কথা, তা হলো সহিষ্ণুতা। একই বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, প্রতিদ্বন্দ্বী বক্তব্যের বইয়েরা নির্বিবাদে সহাবস্থান করে, যেমনটি সমাজে থাকার কথা, রাষ্ট্রে থাকার কথা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক একটি পরিবর্তন হয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৬ বছরের শাসক দেশ ছেড়েছে। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও একক ভাষাভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রচণ্ড প্রতাপশালী নেতারা দেশ ছেড়েছেন বা আত্মগোপনে আছেন। এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি পৃথিবীর ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল। আক্ষরিক অর্থেই মসনদ কাঁপানো এই আন্দোলনের ফলে একটি নতুন প্রজন্ম মুখোমুখি হয়েছে ইতিহাসের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও এরকম কিছু দিন বদলের স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলো এই জাতির ভাগ্যাকাশে। এবারের গণঅভ্যুথানে শাসক পালিয়েছে এটি সত্যি, কিন্তু মানুষের মননজগতে যে ক্ষয়ক্ষতি আর ট্রমা —সবকিছুর ব্যাপকতা অভূতপূর্ব। বছরের মাঝামাঝি বর্ষাসিক্ত এই ভঙ্গুর চব্বিশ সাল আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না, কিন্তু যেখানেই নিয়ে যাক; আমরা যেন ইতিহাস পাঠ থেকে মুখ না ফেরাই।
তীব্র ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ফলে উল্লসিত বা উদ্বিগ্ন দুই শ্রেণির পাঠককেই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠে মন দিতে হবে। ইতিহাসকে জানতে হবে বর্তমানকে বোঝার জন্য। বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে সমব্যথী মন নিয়ে নির্মোহ ইতিহাস অনুসন্ধানী মন তৈরি করতে হবে। একটি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্থের ভবিষ্যত দেখতে চায় যারা, সেই চাওয়া পূরণের একটি বড় উপলক্ষ এখন রাজনৈতিক ইতিহাসরধর্মী বইপাঠ।
লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।