বিজেপি নেতা রাজনাথ সিংয়ের গণতন্ত্র!
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ১২ ডিসেম্বর রবিবার দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, বাংলাদেশের 'গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়' ভারতের ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালে শহীদ ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে 'ওয়াল অব ফেম' এরও উদ্বোধন করা হয়। পরের দিন অর্থাৎ আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলো রাজনাথ সিং-কে উদ্ধৃত করে সংবাদ পরিবেশন করে। '৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা সবসময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। তার আগ পর্যন্ত এদেশের অকুতোভয় মুক্তিবাহিনি যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে ভারতের ২৬০০ সেনা নিহত হন এবং প্রায় ৬০০০ হাজার সেনা আহত হন। ভারতের ৭৩টি ট্যাংক এবং ৪৫টি যুদ্ধবিমান পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
ভারত আমাদের এখান থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া সর্বস্ব হারানো ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ভারত প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। আমরা জাতিগতভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবেও সব সময় ভারতের এই অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
রাজনাথ সিং (৭০) ভারতের অন্যতম বর্ষীয়ান নেতা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। এর আগে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সাবেক সভাপতি। বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মানুষটি মাত্র ১৩ বছর বয়সে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) যোগ দেন। সারা জীবন অতিবাহিত করছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায়। তিনি যখন বলেন, "বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভারত ভূমিকা রেখেছে" তখন শুনতে একটু অন্য রকম লাগে। কৌতূহল হয় মি. সিং গণতন্ত্র বলতে ঠিক কোন ব্যবস্থাকে বোঝাতে চেয়েছেন। কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থা দিয়ে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, ভারত নিজেই তার বড় উদাহরণ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এমন কি কেন্দ্রেও কর্তৃত্ববাদের কথা অনেকেই বলেন।
গোটা ভারত জুড়ে এত তন্ত্রমন্ত্র থাকতে আম্বেদকাররা সংবিধান রচনার সময় কেন গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছিলেন সেটা মনে রাখা দরকার। গণতন্ত্র মানে জনগণের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা। জনগণ সরকার গঠন করবে, সরকার চালাবে এবং নিজেদের কথা ভেবেই তারা সরকার চালাবে। গণতন্ত্রে সবার সমান অধিকার ও স্বাধীনতা থাকবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত প্রাধান্য পেলেও সংখ্যালঘু মত এবং বিরোধী স্বরকে পূর্ণ মর্যাদা ও জায়গা দেওয়া হবে। অবাধে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকবে। ২০০ বছরের পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত ভারতবাসীর জন্য বুকভরা আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে আম্বেদকাররা সেদিনের সংবিধান রচনা করেছিলেন।
১৩০ কোটির দেশ ভারতের ১০০ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে। ভারত এখন চরম অসাম্যের দেশ, সীমাহীন সংকট ও অসন্তোষ- এইসব হাজারো সংকট লুকানোর জন্য কুসংস্কার, ধর্মীয় হিংসা, জাতপাত, প্রাদেশিকতা, অনুপ্রবেশের সমস্যা, গোরক্ষা, সন্ত্রাসবাদ, কাশ্মীর, জাতীয়তাবাদ, এনআরসি, ব্যর্থ চন্দ্রযান ইত্যাদিকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা অপরিহার্য। নিবার্হী বিভাগের প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা ছাড়া গণতন্ত্র চিন্তা করা যায় না। কিন্তু আজকের ভারতের বিচার ব্যবস্থা সরকার অনুগত। অবসরের পর বিচাপতিরা কোন না কোন রাজ্যের রাজ্যপাল হয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনি থেকে অবসরের পর মন্ত্রী হচ্ছেন, বেসামরিক আমলাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে বিচারপতি, আমলা সবাই আজ সরকারের বশংবদ বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছে।
বিশাল এক দেশ ভারত। বহু ধর্মের মানুষের বাস এখানে। জনসংখ্যার ৮০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এরপরেই মুসলমানদের স্থান, জনসংখ্যার হার ১৪ দশমিক ২৩ ভাগ। খ্রিস্ট ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের হার যথাক্রমে ২.৩০ ও ১.৭২ ভাগ। ২০ কোটির ওপর মুসলমানের এই সংখ্যাটি যে কোনো মুসলমানপ্রধান দেশের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম, ভাষায় বিভক্ত ভারতকে এক কাঠামোয় রাখতে সংবিধান প্রণেতারা নানা ধরনের রক্ষাকবচের কথা ভেবেছিলেন। অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ রাজ্যের জন্য যেমন উত্তর-পূর্বাঞ্চল, কাশ্মীর, অন্ধপ্রদেশ বিশেষ মর্যাদা তথা সীমিত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। উদ্দেশ্য হলো, কোথাও বিশেষ কোন কর রেয়াত, বা চাকরির সুযোগ বা বিশেষ কোন মর্যাদা যা একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোয় ভারতের ঐক্য ও অখন্ডতা টিকিয়ে রাখা। কিন্তু ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ৭০ বছরের ঐক্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চল নাগাল্যান্ডের স্তিমিত হয়ে যাওয়া বিছিন্নতাবাদি তৎপরতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন এই অসন্তোষ অন্যান্য রাজ্যেও ছড়াতে পারে। ৩৭১-এ ও ৩৭১-জি ধারা বলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো একই ধরনের সুবিধা পায়। ভারতের নারী সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে এ পর্যন্ত কাশ্মীরে প্রায় ১৫ হাজার তরুণ নিখোঁজ রয়েছেন, যাদেরকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তুলে নিয়েছিল এবং তাদের আর ফেরত পাওয়া যায়নি।
প্রায় দেড় বছর ধরে চলা ভারতীয় কৃষকদের আন্দোলনের কাছে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের। এ এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের নজির স্থাপন। মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের কৃষকরা এই অসাধ্য সাধন করেছে। এক বছরের অধিক সময় রাজধানী দিল্লির অবরোধ আন্দোলনে কৃষকদের দাবিমতে কয়েকশ কৃষক জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তারা পিছু হটেননি।
এদিকে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন প্রকাশ্যস্থানে নামাজ না পড়তে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কথা বলে শেষ করা যাবে না। কোভিড নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতা তিনি ঢাকেন ধর্মীয় উগ্রতা দিয়ে। বহু মুসলমান ভয়ভীতির মধ্যে বসবাস করছে। সাম্প্রদায়িকতার পিছনে কেবল যোগী নন তার আগেও রয়েছে গুজরাট। এনআরসি এবং সিএএ দিয়ে মুসলমানদের চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীন করে তোলা হয়েছে। এরকম একটি অবস্থার মধ্যে রাজনাথ সিংয়ের গণতন্ত্র বিষয়ক আলোচনাটি বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে।
১৯৭১ সাল, মি. সিং এর বিবাহের বছর। মাত্র ২০ বছর বয়সী তরুণ যুবা একটি অসম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের বাসিন্দা। সেই মানুষ যখন ৫০ বছর পর ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে কথা বলেন তখন এই দুই ভারত এক নয়। এই ভারতে সংবিধান প্রণেতাদের মূলনীতির স্তম্ভগুলো একটা একটা করে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এই ভারত এখন ভীষণ সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী ও একইসাথে অগণতান্ত্রিক। ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের আম্বেদকারদের পাঠশালায় সভ্যতা ও গণতন্ত্রের পাঠ নেওয়া উচিত।