আমির হামজা: বাংলার বব ডিলান!
আমি একজন আমির হামজাকেই চিনতাম। তিনি ইন্দো-পারসিয়ান মহাকাব্যগ্রন্থের নায়ক আমির হামজা, যাকে অনেকে পারসিয়ান আলিফ লায়লাও বলেন। রুদ্ধশ্বাস মুগ্ধতা নিয়ে এই মহাকাব্য পড়েছিলাম বছর পনেরো আগে। তখন থেকে নামটা মনে গেঁথে আছে। দাস্তান-ই-আমির হামজা—বিশালায়তনের অসামান্য এক গ্রন্থ। এর পরতে পরতে মেশানো রোমাঞ্চ, প্রেম আর আমির হামজার বীরত্ব। ভারতবর্ষে সপ্তদশ শতকে আমির হামজার কাহিনি এসেছে পুঁথির চরিত্র হয়েও। এই আমির হামজার দুষ্প্রাপ্য পুঁথি সংরক্ষিত আছে বাংলা একাডেমিতেও।
কিন্তু গতকাল এক আমির হামজার নাম শুনে ভীষণ ভিরমিই খেলাম। এই নামটা কোনোদিনই শুনবার কথা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার বদৌলতে জানা হলো। এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন আমির হামজা নামে এক ব্যক্তি। কস্মিনকালেও বাংলাদেশে এ নামের কোনো সাহিত্যিকের নাম শুনিনি, ছোটখাটো একজন সাহিত্যকর্মী হিসেবে। এবং শুধু আমি নই, সাহিত্যের মোটামুটি পাঠক বা খোঁজখবর রাখেন এরকম কেউই তার নাম শোনেননি। তাহলে এরকম একজন ব্যক্তি দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি কীভাবে করায়ত্ত করে ফেললেন? পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত নাম হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু কে এই আমির হামজা? তিনি একজন মরমী গায়ক। গান লিখেছেন, তার দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে: (আসলে বই একটিই, ২০১৮ সালে মাগুরার শ্রীপুরের সারথি ফাউন্ডেশন থেকে 'বাঘের থাবা' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়।) পরে ২০১৯ সালে এই বইয়েরই গান অংশ নিয়ে বের হয় আরেকটি বই, 'পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি'। আরেকটি সূত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে, ২০২১ সালে প্রয়াত আমির হামজার আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে, নাম, 'একুশের পাঁচালি'।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আমির হামজা-বিষয়ক এই জ্ঞান অর্জনের পর বিমূঢ় না হয়ে উপায় নেই। অন্তত আমার জন্যও। মনে প্রশ্ন জাগে, 'পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি' তিনি কি শুধু এই বইটির জন্যই স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন? এটি একটি গানের বই! এই বইয়ের জন্য পুরস্কার? হিসেব মেলে না। একটি গানের বই লিখেই দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল আমির হামজার!
সাইমন জাকারিয়া একজন লোকসংস্কৃতি গবেষক এবং নাট্যকার, বাংলা একাডেমির ফোকলোর উপবিভাগের সহপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটা পোস্টে আরও কূলহারা হয়ে গেলাম। তিনি লিখেছেন:
'…আমরা নিশ্চিত বহু সাধক কবি ও তাঁদের সৃষ্টিকর্ম আমাদের আলোচনা-সমালোচনার বাইরে রয়ে গেছে। এ বছর স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত সাধক কবি আমির হামজা তাঁদের একজন। তিনি ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ১০ই নভেম্বর মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবেশনের ধারায় প্রতিযোগিতামূলক আসরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংগীত রচনা ও পরিবেশন করতেন। তত্ত্বগানের পাশাপাশি সমকালীন সময়, রাজনীতি, ইতিহাসনির্ভর গান রচনা করেছেন। রচিত গানের সংকলন স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে 'বাঘের থাবা', 'পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি', 'একুশের পাঁচালি' প্রভৃতি শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। এবছর সাহিত্য বিভাগে সাধক কবিদের ভেতর থেকে একজন প্রয়াত সাধক কবি আমির হামজাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সাধক কবিদের ভেতর থেকে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদানে লোকায়ত সংস্কৃতির একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক হিসেবে পদক প্রদান কমিটিকে সাধুবাদ জানাই।'
সাইমনের কথা মেনে নিলে বলতে হবে এটা অবশ্যই ঐতিহাসিক ঘটনা। সরকার একটা দারুণ কাজ করে ফেলেছে কোনো সন্দেহ নেই। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা একজন প্রকৃত কবি-সাহিত্যিককে খুঁজে বের করে পুরস্কৃত করেছে। সাধুবাদ পাওয়ার মতোই কাজ।
কিন্তু ঘটনা তো তা নয়। এই আমির হামজাকে একজন প্রকৃত সাধক কবি হিসেবে মেনে নিলে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। যদি প্রশ্ন করি তিনি কি শাহ আব্দুল করিম, দুরবিন শাহ, বিজয় সরকার—এরকম আরো মরমি সাধকদের নাম করা যায়—আমির হামজা এদের চেয়েও বড় মরমি লেখক? যাদের নাম বললাম, এরা কেউ স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি।
সাইমন জাকারিয়া আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, 'নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বব ডিলানকে যে কারণে সাহিত্যে নোবেল দিয়েছিলেন ধরে নিন সেই একই কারণে আমির হামজাকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক দিয়েছে।'
এটা পড়ে স্থাণু হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। আমির হামজা আর বব ডিলান এক? বব ডিলান সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা থাকলে এবং বুদ্ধিভ্রংশ না ঘটলে এ কথা কেউ বলবেন না, বব ডিলান একজন পৃথিবী বিখ্যাত গায়ক, গীতিকার, সুরকার, ডিস্ক জকি, এবং একইসঙ্গে তিনি শক্তিধালী একজন কবি। তার গানের লিরিক আর আমির হামজার গানের লিরিক কি তুলনীয়?
ষাটের দশক থেকে পাঁচ দশকেরও অধিক সময় ধরে মার্কিন সংগীতের অন্যতম প্রধান পুরুষ বব ডিলান। তার সঙ্গে আমির হামজা? এবং রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন 'গীতাঞ্জলি'র অনুবাদের জন্য। সেইসঙ্গে তার দীর্ঘ সাহিত্যজীবনের অন্যান্য মহান কর্ম তো আছেই। কীভাবে বব ডিলান ও রবীন্দ্রনাথের মতো দুই নামের সঙ্গে আমির হামজার নাম উচ্চারিত হতে পারে?
আমির হামজা কিছু গান লিখেছেন, গানের একটি প্রশস্তি পুস্তিকা রচনা করে বাংলার বব ডিলান বনে গেছেন? ধরণী দ্বিধা হও।
বব ডিলান এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনই নোবেল বিজয়ী লেখক। তাদের নোবেল পুরস্কার দিয়েছেন কারা? আর আমির হামজাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছেন কারা কোন প্রক্রিয়ায়?
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য প্রতি বছর সুইডিশ একাডেমির সদস্য ও সমাজের, সাহিত্যের নানা দিকপাল লেখক, গবেষক, ভাষাবিদ, পূর্ববর্তী নোবেল পুরস্কার জয়ী সাহিত্যিক, লেখক-সাহিত্যিকদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রধানদের পাঠানো নাম থেকেই নোবেলের চূড়ান্ত জয়ী নির্বাচিত হয়। এখানে পক্ষপাত বা তদবিরের কোনো সুযোগ নেই। আর বিস্তারিত আলোচনা না করি, আসলে নোবেল পুরস্কার জয়ীকে নির্বাচিত করার জটিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের দেশের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা বা তুলনা করা শুধু হাস্যকরই নয় মূর্খতারও শামিল।
আমির হামজার প্রাপ্ত আমাদের স্বাধীনতা পুরস্কার কীভাবে কারা দেন একটু দেখি।
এই পুরস্কার দেন 'জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি'। এই কমিটিতে আছেন ১৩ জন মন্ত্রী (তাদের কেউই সাহিত্যিক নন)। আর তাদের পুরস্কার প্রদানে সহায়তা করেন ১০ জন আমলা। তাদের কেউও কবি-সাহিত্যিক বা লেখালেখির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।
নোবেল পুরস্কারের কথা ভুলে যাই, বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের কিছু সাহিত্য পুরস্কার—যেমন প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, কালি-কলম পুরস্কার ইত্যাদি—এরাও এসব পুরস্কার দেওয়ার সময় কমিটি গঠন করেন দেশের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক, গবেষকদের নিয়ে। তার বিপরীতে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো দেশের সর্বোচ্চ একটি পুরস্কার নির্ধারিত হয় শুধুমাত্র কয়েকজন মন্ত্রী-আমলার মাধ্যমে। বিস্ময়কর। এই পুরস্কার প্রদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে পৃথিবীর মানসম্পন্ন কোনো পুরস্কারেরই তুলনা চলবে না আসলে। এটা একটা নিকৃষ্ট প্রক্রিয়া, কোনো আমলা কমিটি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।
তাদের হাতে এই ক্ষমতা থাকার কারণে দেখুন কী ঘটেছে, আমির হামজার মতো এরকম অজ্ঞাতকুলশীল লেখক-কবি আগেও পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন:
এই গেল বছরই, ২০২০ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারের কথা কি স্মরণ আছে? রইজ উদ্দিন আহম্মদ নামে এক ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। 'কুমড়ী গ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য'—এই হলো তার বইয়ের নাম।
আর এবার পেলেন আমির হামজা!
প্রয়াত মরমি কবি আমির লিখেছেন 'বাঘের থাবা', সেটাকে ভেঙে আরেকটি গানের বই হয়েছে: 'পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি'।
কোন প্রক্রিয়ায় জনাব আমির হামজা এই বিস্ময়কর কাজটি করলেন? কীভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার বাগিয়ে ফেললেন?
আমির হামজার পুরস্কার প্রাপ্তি বড় সূত্র হচ্ছে তার মেজো ছেলে মো. আসাদুজ্জামান। বর্তমানে তিনি উপসচিব। আমলা। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী।
তার উদ্যোগেই পিতার রচনার গানের অংশ আলাদা করে প্রকাশিত হয়, 'পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি'। পুরস্কারের জন্য এটা বড় ঘটনা! দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মো. আসাদুজ্জামান তার সাহিত্যিক বাবার নাম প্রস্তাব করেছেন; আর তাকে সমর্থন দিয়েছেন আরেকজন আমলা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি আমির হামজার লেখা পড়েননি। তিনি সহকর্মী আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে অবহিত হয়েছেন যে, তার বাবা প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা, পালাগান করতেন এবং পরবর্তী সময়ে সাহিত্য রচনা করেছেন।
তারপর আমির হামজাকে নির্বাচিত করেছেন ১৩ জন মন্ত্রী ও ও ১০ জন সচিব।
এই লেখার সময় কয়েকটি নাম চোখের সামনে না চাইলেও চলে আসছে—আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিম আল দীন, গায়ক আজম খান, যারা জীবিত অবস্থায় কোনো রাষ্ট্রীয় পদকই পাননি। শহীদুল জহির, তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পাননি।
প্রয়াত আমির হামজার জন্য আমার বেদনা হচ্ছে। তিনি কখনও কল্পনাও করেননি এই পুরস্কারের, তার এভাবে সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার কথা না।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে রইজ উদ্দিনকে পুরস্কার দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় পড়ে যায়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে তার পুরস্কারটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
একটা সংযোজন দেই:
মো. শাহাদাত হোসেন ফকির নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন প্রয়াত আমির হামজা। ১৯৭৮ সালের ঘটনা এটা। গরুর ক্ষেতের ফসল খাওয়ার ঘটনা নিয়ে খুনোখুনির ঘটনাটা ঘটে। এ ঘটনায় আমির হামজা ও তার ভাইসহ মোট ৬ জনের কারাদণ্ড হয়। আট বছর জেল খাটার পর ১৯৯১ সালের মাগুরার এক মন্ত্রী, মজিদুল হকের সহায়তায় বেরিয়ে আসেন আমির হামজা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের মাগুরা প্রতিনিধি জানাচ্ছেন এ বিষয়ে আমির হামজার ছেলে আসাদুজ্জামান, যিনি একজন আমলা, তিনিও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন: তার বাবা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। তবে বাবাকে জীবদ্দশায় তিনি ভালো মানুষ হিসেবেই জেনেছেন। উদার মানুষ ছিলেন তার বাবা। মানুষকে ভালোবাসতেন। সন্তান হিসেবে তার রচিত গান-কবিতাগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন তিনি। রাষ্ট্র তার বাবার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি সারা মাগুরার মানুষের জন্যে গৌরবের, দাবি করেছেন তিনি।
সিরিয়াসলি! সারা মাগুরার মানুষের জন্যে গৌরবের?
এরপর বাকরহিত হওয়া ছাড়া আর কি বলার থাকে!