কুকুরের মাংসের ব্যবসা নিষিদ্ধ করতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া সরকার, বাধা দিচ্ছেন খামারিরা
কিম জং-কিল সারি সারি লোহার খাঁচার দিকে অগ্রসর হতেই কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করতে লাগলো এবং কিমের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা খাঁচার দরজা খুলে তিনি একটা কুকুরের ঘাড়ে, বুকে আদর করে দিলেন। ছোট চুলের, লোমশ এই প্রাণীগুলোকে মাংসের জন্য বিক্রি করেন তিনি; এটাই তার ব্যবসা।
কিম জানান, গত ২৭ বছর ধরে কুকুরের মাংসের খামার পরিচালনা করে আসছে তার পরিবার এবং এ নিয়ে তিনি খুবই গর্বিত। আগামী দিনে নিজের সন্তানদের হাতে এই ব্যবসা তুলে দেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় কুকুরের মাংসের ব্যবসা নিষিদ্ধ করতে রাজনীতিবিদ এবং অধিকারকর্মীদের জোর প্রচেষ্টার ফলে এই শিল্পের ভবিষ্যত এখন অনিশ্চয়তার মুখে।
সিউলের দক্ষিণে পিয়ংতেক শহরে নিজের খামারে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ৫৭ বছর বয়সী কিম বলেন, "আমার অনুভূতিটা আসলে খারাপ লাগার চাইতেও বেশি কিছু। আমি এই উদ্যোগের সরাসরি বিরোধিতা করছি এবং এটা প্রতিরোধের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।"
কুকুরের মাংস খাওয়া কোরিয়ান উপদ্বীপে শতবর্ষী পুরনো একটি চর্চা এবং গ্রীষ্মকালে এটা শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে বলে তাদের বিশ্বাস। দক্ষিণ কোরিয়ায় এখন পর্যন্ত এটি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ নয়, আবার সম্পূর্ণ বৈধও নয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আরও বেশি মানুষ কুকুরের মাংস নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছেন। দেশটিতে প্রাণী অধিকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দক্ষিণ কোরিয়ার ইমেজ বজায় রাখার বিষয়টিও চিন্তা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ফার্স্ট লেডি কুকুরের মাংস নিষিদ্ধের প্রতি তার সমর্থন জানানো এবং দুজন আইনপ্রণেতা এই ব্যবসা নিষিদ্ধের জন্য বিল উত্থাপন করার পর দেশটিতে কুকুরের মাংস-বিরোধী ক্যাম্পেইন জোরাল হয়েছে।
"বিদেশীরা ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ান একটা সাংস্কৃতিক পাওয়ারহাউজ। কিন্তু কে-কালচার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যত বেশি নিজের অবস্থান শক্ত করছে, বিদেশীরা আমাদের কুকুরের মাংস খাওয়া দেখে তত বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছে", বলেন বিরোধ দলের একজন আইনপ্রণেতা হান জিউংগে। হান নিজেই গত মাসে কুকুরের মাংসের ব্যবসা অবৈধ ঘোষণার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন।
কিন্তু দেশটিতে কুকুরের মাংস-বিরোধী আইন পাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়; কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষক, রেস্টুরেন্ট মালিক কুকুরের মাংসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অন্য সবাই এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জরিপে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন দক্ষিণ কোরিয়ানের মধ্যে একজন এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেন; যদিও দেশটিতে অধিকাংশ মানুষই এখন আর কুকুরের মাংস খান না।
শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার নয়; চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং ঘানা, ক্যামেরুন, কঙ্গো ও নাইজেরিয়ার মতো আফ্রিকার কিছু দেশেও কুকুরের মাংস খাওয়া হয়।
গত মাসের শুরুতে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ সুলাওয়েসি দ্বীপের একটি অ্যানিমেল মার্কেটে কুকুর ও বিড়াল হত্যা বেআইনি ঘোষণা করেছে। স্থানীয় অধিকারকর্মী এবং বিশ্বের খ্যাতনামা তারকাদের বছরব্যাপী ক্যাম্পেইনের পর এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ইন্দোনেশিয়া। প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে কাজ করা একটি গোষ্ঠী, হিউমেন সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, তমোহন এক্সট্রিম মার্কেটই হবে ইন্দোনেশিয়ায় এ ধরনের প্রথম মার্কেট, যেখানে কুকুর ও বিড়ালের মাংস বিক্রি হবে না।
দক্ষিণ কোরিয়ার কুকুরের মাংস বেচাকেনার শিল্প এর আগেও আন্তর্জাতিক মহলের নজরে এসেছে, যেহেতু সম্পদশালী এবং অতি-আধুনিক গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার খ্যাতি রয়েছে।
তাছাড়া, দক্ষিণ কোরিয়াই একমাত্র দেশ যেখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে খামারগুলোতে উৎপাদন হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বেশিরভাগ খামারেই পাঁচশোর বেশি কুকুর রয়েছে বলে জানিয়েছে এই খামারিদের একটি সংঘ।
কিম জং-কিলের খামার দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় কুকুরের খামারগুলোর মধ্যে একটি। তার খামারে ৭০০০ কুকুর রয়েছে। কিমের খামারটি পরিদর্শনকালে দেখা যায়, খামারটি মোটামুটি পরিষ্কারই রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু স্থানে তীব্র দুর্গন্ধ ছিল। সব কুকুরকেই খাচায় রাখা হয়েছে এবং এদেরকে খাবারের অবশিষ্টাংশ ও মুরগির মাংস খেতে দেওয়া হয়। কুকুরগুলোকে বাইরে খুব একটা ছাড়া হয়না বললেই চলে এবং জন্ম নেওয়ার এক বছরের মাথায়ই মাংসের জন্য এগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
কিম জানান, তার ২৯ বছর এবং ৩১ বছর বয়সী দুই সন্তান রয়েছে; তারাই এখন তার সঙ্গে এই খামারের দেখাশোনা করছেন। কিম জানান, তার ব্যবসা এখন পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছে। তিনি আরও জানান, যেসব কুকুরকে মাংসের জন্য পালন করা হয় সেগুলো পোষা কুকুরের চাইতে আলাদা হয়; যদিও এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন অধিকারকর্মীরা।
যদিও সিউলের কেন্দ্রস্থলে কুকুরের মাংসের রেস্টুরেন্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এখনও এ ধরনের অনেক রেস্টুরেন্ট আছে।
"আমি আগে যা আয় করতাম, এখন তার তিনভাগের একভাগ আয় করি। তরুণরা এখন আর রেস্টুরেন্টে আসে না। শুধুমাত্র বৃদ্ধরা দুপুরের খাবার খেতে আসে", বলেন ৭৭ বছর বয়সী ইয়ুন চু-ওল। সিউলের কিয়ুংডং মার্কেটে তার রেস্টুরেন্টে কুকুরের মাংস পাওয়া যায়। "আমি বয়স্ক ক্রেতাদের বলি যে, নিষিদ্ধ হওয়ার আগেই যেন ঘন ঘন আমার রেস্টুরেন্টে এসে খায়", বলেন ইয়ুন।
এছাড়াও, খামারিরা প্রায়ই কর্তৃপক্ষের তদন্ত এবং জনসাধারণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। তাদের অভিযোগ, খামারগুলোতে প্রাণীদের নির্যাতন করা হচ্ছে- অধিকারকর্মী এবং নাগরিকদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে কর্মকর্তারা বারবার তাদের খামার পরিদর্শনে আসেন। কিম জানান, গত চার মাসে তার খামারের বিরুদ্ধে এ ধরনের ৯০টিরও বেশি পিটিশন জমা পড়েছে।
ডগ ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সন ওক হাক বলেন, কুকুরের মাংসের দাম এবং চাহিদাও কমে যাওয়ায় সম্প্রতি কয়েক বছরে বহু খামারির ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তিনি মনে করেন, অধিকারকর্মীদের ক্যাম্পেইন এবং অপেক্ষাকৃত খারাপ খামারগুলোকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমের অসাধু প্রতিবেদনের কারণে এমনটা হয়েছে। তবে কেউ কেউ জানিয়েছেন, তরুণরা কুকুরের মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকায় এটির চাহিদা এমনিতেও কমে আসছিল।
সন বলেন, "সত্যি কথা বলতে, আমি আমার কাজটা (খামারি হিসেবে) পারলে আগামীকালই ছেড়ে দিতে চাই। আমরা সন্তানদের কাছে জোর গলায় বলতে পারি না যে আমরা কুকুর পালন করছি। আমার বন্ধুরা যখন কল দেয়, তখন বলে- কি তুমি এখনো কুকুরের মাংসের খামার চালাচ্ছো? এটা তো অবৈধ, তাইনা?"
ডগ ফার্মারস' অ্যাসোসিয়েশন জানায়, কয়েক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় কুকুরের মাংসের খামারের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে দেশটিতে ৩০০০ থেকে ৪০০০ খামার রয়েছে এবং প্রতিবছর ৭০০,০০০ থেকে ১ মিলিয়ন কুকুর মাংসের জন্য হত্যা করা হয়। যদিও ১০-২০ বছর আগে বছরে কুকুর হত্যা করা হতো কয়েক মিলিয়ন। তবে অধিকারকর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, খামারিরা সংখ্যা বাড়িয়ে বলছেন এটা বোঝাতে যে তাদের শিল্প কত বড় এবং এটা ধ্বংস করা কঠিন।
কুকুরের মাংসের ব্যবসা অবৈধ ঘোষণা করা উচিত কিনা তার জন্য ২০২১ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ কোরিয়া একটি গভর্নমেন্ট-সিভিলিয়ান টাস্ক ফোর্স গঠন করে। কৃষক এবং প্রাণী অধিকারকর্মীরা এই কমিটির সদস্য ছিলেন। তারা ২০ বারের বেশি সাক্ষাৎ করলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি, মূলত ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সমাধান না করতে পারায়।
গত এপ্রিলে ফার্স্ট লেডি কিম কেও হি অধিকারকর্মীদের সাথে একটি সভায় বলেন, তিনি আশা করছেন যে দক্ষিণ কোরিয়ায় কুকুরের মাংস খাওয়া বন্ধ হবে। কিন্তু এর প্রতিবাদে মিছিল করে দেশটির কৃষক-খামারিরা এবং তাদের জীবিকায় আঘাত করার অভিযোগে কিমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেয়।
আইনপ্রণেতা হান বলেন, তার প্রস্তাবিত বিলে যেসব কৃষকরা খামার বন্ধ করে দিতে সম্মত হবেন, তাদেরকে সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় আনার কথা উল্লেখ রয়েছে। খামার উঠিয়ে নেওয়ার জন্যও তাদেরকে টাকা দেওয়া হবে; বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সহায়তা এবং অন্যান্য সুবিধাও দেওয়া হবে।
ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা জু ইয়ুংবং বলেন, কৃষকের চায় আরও ২০ বছর এই ব্যবসা চালিয়ে নিতে, যতদিন পর্যন্ত তা তাদের বর্তমান ক্রেতা- বয়স্করা মারা না যাচ্ছেন। অর্থাৎ, এর ফলে এই শিল্প স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে যাবে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বেশিরভাগ কৃষকদের বয়সও এখন ষাট থেকে সত্তরের কোঠায়।
কিন্তু হিউমেন সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল-এর দক্ষিণ কোরিয়া শাখার পরিচালক বোরামি স বলেন, এত লম্বা সময় ধরে লাখ লাখ কুকুর হত্যা কার্যক্রম চলতে দিতে তিনি নারাজ।
কোরিয়া অ্যানিমেল রাইটস অ্যাডভোকেটস-এর প্রধান চান জিনকিয়ুং বলেন, "কুকুরের মাংস খাও খুবই আদিম একটি অভ্যাস, এর মাধ্যমে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায় এবং এটা আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ব্যহত করে।"