যে কারণে ফিলিস্তিনের প্রতীক হয়ে উঠল তরমুজ
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ফিলিস্তিনের সমর্থনকারীদের রাস্তায় তরমুজ হাতে দেখা যাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভে আসা ব্যক্তিদের হাতে তরমুজের টুকরা তুলে দেওয়া হচ্ছে। কেউ বা তাদের মুখমণ্ডলে তরমুজের ছবি আঁকছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজা যুদ্ধের পোস্টগুলোর সঙ্গেও তরমুজের ছবি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্ত কেন এমনটা করা হচ্ছে? এই পরিপ্রেক্ষিতে তরমুজের ব্যবহারের অর্থই বা কী? কেনই বা এটি ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদেরকাছে একটি বিশেষ প্রতীক হয়ে উঠেছে?
ফিলিস্তিনের সমর্থনকারীদের কাছে তরমুজ কেবল একটি ফলই নয়। ফলটি প্রকৃতপক্ষে কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও প্রায়ই ফিলিস্তিনের পতাকা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রঙ সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রঙ লাল, সাদা ও কালো। এ রঙগুলো ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাছাড়া ফিলিস্তিনে স্থানীয়ভাবে জন্মানো এ ফলটি বেশ জনপ্রিয়্ও।
দ্বিতীয়ত বাস্তবিক আরেকটি কারণ হলো ফিলিস্তিনের পতাকা প্রদর্শন করা প্রায়শই নিষিদ্ধ কিংবা কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আরব গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ের অধ্যাপক দিনা মাতার বলেন, 'এক অর্থে ফিলিস্তিনিরা তরমুজকে ফিলিস্তিনি বলে দাবি করে থাকে'।
তিনি আরো বলেন, তরমুজকে 'প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়।' ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের এ ফল বহনের অর্থ হলো তারা যে ফিলিস্তিনি সেটি বোঝানো।
পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনি শিল্পী খালেদ হুরানি ২০২১ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন যে শিল্প 'কখনও কখনও রাজনীতির চেয়েও বেশি রাজনৈতিক হতে পারে।' তরমুজের এই বিষয়টি হুরানির বেশ কয়েকটি কাজের অনুপ্রেরণা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমনকি সম্প্রতি গাজা-ইসরায়েলে সংঘাতের প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তরমুজের এ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে।
লাল, সবুজ, সাদা ও কালো রঙে চিত্রিত ফিলিস্তিনের পতাকার প্রদর্শন নিয়ে কয়েক দশক ধরে বিতর্ক চলে আসছে। তরমুজের চারটি রঙের সঙ্গে ফিলিস্তিনের পতাকার রঙগুলোর মিল থাকার কারণে বিকল্প হিসেবে তাই তরমুজের ব্যবহার আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েল অতীতে কিছু ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি পতাকা ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিছু ইসরায়েলি রাজনীতিক আনুষ্ঠানিকভাবে আবার তা করার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে পতাকাটি কার্যত নিষিদ্ধ। কারণ এ পতাকার উত্তোলন ইসরায়েলি জননিরাপত্তা অধ্যাদেশের আওতায় শাস্তিযোগ্য হতে পারে।
গত জানুয়ারিতে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী পুলিশকে উন্মুক্ত স্থানগুলো থেকে এ পতাকা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
কয়েক মাস পর জনসমক্ষে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে একটি গোষ্ঠী ট্যাক্সিগুলোতে তরমুজের ছবিযুক্ত পোস্টার লাগানো শুরু করে। সেই পোস্টারে এও লেখা হয়যে 'এটি ফিলিস্তিনি পতাকা নয়'।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বিশেষ একটি উদ্দেশ্যে তরমুজের ইমোজি (প্রতীক) ব্যবহার করে থাকেন। কারণ ফিলিস্তিনের সমর্থনকারীরা বাচনিকের পরিবর্তে সাংকেতিক ভাষায় প্রতিবাদের দিকে ঝুঁকছে, যাতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে করা তাদের পোস্ট নিয়ে আপত্তি জানাতে না পারে বা সেগুলো দমন করতে না পারে।
২০২১ সালে ফিলিস্তিনের সমর্থনে করা কয়েক লাখ পোস্ট সরিয়ে নিয়েছিল ফেসবুক ও টুইটার (বর্তমানে এক্স নামে পরিচিত)।
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে আকষ্মিক হামলা চালানোর পর মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলেছে, ইসরায়েলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
ইসরায়েলের নাজারেথের হাম্মাস রেস্তোরাঁর মালিক ইয়ারমোক জোয়াবিকে ফিলিস্তিনের পতাকাযুক্ত একটি হোয়াটস্ অ্যাপ স্ট্যাটাসের কারণে এক রাত জেলে কাটাতে হয়েছে।
ইউরোপেও ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে তুমুল বিতর্ক রয়েছে। জার্মানির বার্লিনের স্কুলগুলোকে ফিলিস্তিনি পতাকার রঙগুলো ব্যবহার করে ইসরায়েলের মানচিত্র নিষিদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গত মাসে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে ফিলিস্তিনি পতাকা প্রদর্শন ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।যদিও লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ স্পষ্ট করেছে যে একাকী ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো ফৌজদারি অপরাধ নয়।
অধ্যাপক মাতারের যুক্তি হলো পতাকাটি শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের পরিচয়ের একটি প্রতীক: যেকোনো জন্য পতাকা উত্তোলন প্রতীক। এর অর্থ এই জাতির সদস্যরা মনে করে তারা নির্দিষ্ট একটি জাতির অন্তর্গত। এ কারণে ফিলিস্তিনি পতাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র নেই, কিন্তু তাদের একটি জাতি আছে।...ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য পতাকা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।