২০২৪ সালে সম্ভবত অচলাবস্থার দিকে এগোচ্ছে ইউক্রেনযুদ্ধ
'আমাদের মূল্যায়নে যুদ্ধ এখন অচলাবস্থায় নেই,' গত আগস্টে জোর দিয়ে বলেছিলেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান। তিনি বলেন, ইউক্রেন 'সুশৃঙ্খল, পদ্ধতিগতভাবে' ভূমি পুনর্দখল করছে।
তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ইউক্রেনের পালটা আক্রমণ এর প্রাথমিক লক্ষ্যের খুব বেশি কাছে যেতে পারেনি এবং যুদ্ধ আদতেই সামরিক অচলাবস্থার মুখে পড়েছে। আগামী বছরটি ইউক্রেনের জন্য কঠিন, বিপজ্জনক একটি সময় হতে যাচ্ছে।
গত জুনে পালটা আক্রমণ (কাউন্টার-অফেনসিভ) শুরু করে ইউক্রেন। এখন পর্যন্ত বাখমুত ও জাপোরিজজিয়া প্রদেশে কিছুটা সাফল্য পেয়েছে দেশটি। এ শীতকালে শ্রান্ত সেনাদল, সীমিত গোলাবারুদ ও ভেজা আবহাওয়ায় আক্রমণ ধীর হয়ে পড়বে। তবে ছোট মাত্রায় পদাতিক আক্রমণ অব্যাহত থাকবে।
এ শীতে উভয়পক্ষ থেকেই দীর্ঘপাল্লার আক্রমণের নতুন ও তীব্র সংঘাত দেখা যেতে পারে। রাশিয়া এর মিসাইলের মজুত বাড়াচ্ছে। দেশটি পুনরায় ইউক্রেনের পাওয়ার গ্রিডগুলোতে হামলা শুরু করতে পারে। অন্যদিকে ইউক্রেন ড্রোনের সংগ্রহ বড় করছে, এটি রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়ায় হামলা অব্যাহত রাখবে।
এছাড়া ইউক্রেনেরও সম্ভাবনা রয়েছে আক্রমণের পরিধি বাড়িয়ে রাশিয়ার পাওয়ার গ্রিডে হামলা করার। রাশিয়ার সমধর্মী হামলা থামাতে ইউক্রেন এ ধরনের পালটা হামলাপদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। তবে এসব হামলায় ইউক্রেনের মনোবল বাড়ালেও এগুলোর স্ট্র্যাটেজিক প্রভাব খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না।
২০২৪ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে কোন পক্ষ অনেক দ্রুত উচ্চ মানসম্পন্ন সেনাদল পুনরায় গড়ে তুলতে পারবে। এটা কিছুটা জনবলের বিষয়। রাশিয়ান সেনাবাহিনী এর নিয়োগের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। তবে সামনের গ্রীষ্মে ফ্রন্টলাইন ধরে রাখার মতো পর্যাপ্ত সেনা ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছে এটি।
রাশিয়া যদি ২০২২–২৩-এর শীতের মতো পুনরায় আক্রমণে যায়, তাহলে দেশটিকে আরও বড় পরিসরে নতুন সেনা ভর্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক ভর্তি করানোর উপযুক্ত বড় সংখ্যক জনশক্তি রয়েছে দেশটির। যদিও তা করাটা রাজনৈতিকভাবে বড় ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আর ইউক্রেনকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটি তার ২০-এর কোঠায় থাকা তরুণদের বাধ্যতামূলক যুদ্ধে পাঠাবে কি না।
এসব সেনাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদও দরকার। ২০২২-এর শেষের দিকে রাশিয়া প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন বাড়িয়ে তুলেছে। ২০২৪ সালে কয়েকশ নতুন ও সংস্কারকৃত ট্যাংকের পাশাপাশি দুই মিলিয়নের বেশি গোলা উৎপাদন করার সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির। উত্তর কোরিয়াও রাশিয়াকে বড় সংখ্যক গোলা দিচ্ছে।
অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো এ খাতে দেরিতে বিনিয়োগ করেছে। তাই এ যুদ্ধে ট্যাকটিক্যাল পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক আর্টিলারি গোলার ক্ষেত্রে ২০২৩-এর শেষ বা ২০২৪-এর শুরুর আগে ইউক্রেনের রাশিয়ার চেয়ে এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা নেই।
এ বছরের বসন্তে ইউক্রেন অস্ত্র ও সরঞ্জামের যে বৃহৎ সরবরাহ পেয়েছিল, এবার আর তা পাবেনা। তার বদলে লক্ষ্য হবে সরঞ্জাম সারানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সাহায্য পাওয়া। পশ্চিমা সরকারগুলোর এখন একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে তারা বর্তামানে নিজেদের অব্যবহৃত কোনো অস্ত্রের উৎপাদন পুনরায় শুরু করবে না ইউক্রেনের কারখানাগুলোতে সংবেদনশীল গোপন তথ্য সরবরাহ করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪-এর শুরুতে ইউক্রেনকে গ্রাউন্ড-লঞ্চড স্মল-ডায়ামিটার বম (জিএলএসডিবি) দেবে। এর ফলে কিয়েভের দীর্ঘপাল্লার মিসাইলভান্ডার আবারও পূর্ণ হয়ে উঠবে। এছাড়া ইউক্রেন এফ-১৬ যুদ্ধবিমানও পাবে। তবে কেবল এ বিমানগুলোর একার পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোনে প্রভাব রাখা সম্ভব হবে না।
সময়ের সদ্ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। দুপক্ষই সেটা করতে চাইবে। ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে বসন্তকালীন অভিযান ধরে রাখতে চায়। কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত ভূসৈন্য সংগ্রহ করা এর জন্য কঠিন হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও চাইবেন তার বাহিনী প্রতীকী আক্রমণ যেন অব্যাহত রাখে। তবে স্বল্প-প্রশিক্ষিত সেনাদের নিয়মিত এভাবে এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিলে ফ্রন্টলাইনে কোনো অগ্রগতি অর্জন ছাড়াই দুর্বল হয়ে পড়বে রাশিয়ান সশস্ত্রবাহিনী।
২০২৪-এর আরেকটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ হলো ইউক্রেনের মিত্ররা প্রশিক্ষণের পরিসর বাড়াতে ও পদ্ধতি পালটাতে পারবে কি না। এ চ্যালেঞ্জটি পরের বছরগুলোর পরিস্থিতিও নির্ধারণ করে দিতে পারে।
ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে অনেকগুলো সমস্যা ধরা পড়েছে। সামনের আক্রমণে আরও সাফল্য পেতে হলে এসব সমস্যার কিছু কিছু সমাধান করতে হবে। যেমন, বিস্তৃত রণাঙ্গনে একাধিক ইউনিটের সমন্বয়ে জটিল অপারেশনের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেওয়ার জন্য ইউক্রেনের ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেডগুলোতে আরও অনেক বেশি দক্ষ অফিসারের দরকার।
২০২৪ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া কোনো পক্ষই যদি অর্থবহ কোনো আক্রমণের হুমকি না দিতে পারে, তাহলে যুদ্ধে রণাঙ্গনের বাইরের অনেক বিষয় বেশি প্রভাব ফেলবে। কৃষ্ণ সাগর আরও বেশি কেন্দ্রীভূত হয়ে যেতে পারে। জৃলাইয়ে ওয়াশিংটনে ন্যাটো সম্মেলনকে পশ্চিমা সমর্থনের পরীক্ষা হিসেবে দেখা হতে পারে।
অন্যদিকে রাশিয়ার কৌশল সাধারণ: ইউক্রেনের মিত্ররা ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। পশ্চিমারাও শেষ দেখে যেতে চায়। আশাবাদী কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধ ক্রমশ রাশিয়ার রাজনীতিতে ফাটল ধরাচ্ছে। কিন্তু নৈরাশ্যবাদীরা সতর্ক করছেন, ভ্লাদিমির পুতিন তার এ লড়াই বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে পারবেন।
শশাঙ্ক জোশি: ডিফেন্স এডিটর, দ্য ইকোনমিস্ট
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।