টেসলাকে টপকে চীনা কোম্পানি ‘বিওয়াইডি’ যেভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ির বৈশ্বিক বাজার দখল করছে
বৈশ্বিকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রিতে শীর্ষে উঠে এসেছে চীনা গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বিওয়াইডি। এক্ষেত্রে তারা পেছনে ফেলেছেন ধনকুবের ইলন মাস্কের বিখ্যাত কোম্পানি টেসলাকে।
গত ৩১ ডিসেম্বরের হিসেবে বছরের শেষ চতুর্থাংশে প্রথমবারের মতো বিওয়াইডি টেসলার তুলনায় বেশি গাড়ি গ্রাহকদের নিকট পৌঁছে দিতে পেরেছে। এতে করে বছর শেষে টেঁসলার তুলনায় গাড়ি বিক্রিতে এগিয়ে গিয়েছে কোম্পানিটি।
বিওয়াইডি প্রথমে ছিল চীনের অখ্যাত ব্যাটারি তৈরির একটি কোম্পানি। আর সেটিই এখন বৈশ্বিক বাজারে টেসলার মতো জায়ান্ট কোম্পানিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
১৯৯৫ সালে ওয়াং চুয়ানফু নামের এক শিক্ষাবিদ বিওয়াইডি প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের শেনচেনভিত্তিক এই কোম্পানিটির পরিচালনার দায়িত্বে এখনো তিনিই রয়েছেন।
ওয়াং জানান, কোম্পানিটির নাম বিওয়াইডি হওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। বরং অন্য স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর থেকে নিজেদের আলাদাভাবে পরিচিত করতেই এমন 'অদ্ভুত নাম' বেঁছে নিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে কোম্পানিটি চীনের শীর্ষ বৈদ্যুতিক গাড়ির নির্মাতা। তারা ট্যাক্সি, বাস ও অন্যান্য যানবাহন ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে থাকে।
ইসরায়েল ও থাইল্যান্ড বিওয়াইডির সবচেয়ে বড় বাজার। দেশ দুটির বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রিতে কোম্পানিটি শীর্ষে রয়েছে।
টেসলার তুলনায় বিওয়াইডি অপেক্ষাকৃত কম দামে গাড়ি বিক্রি করে থাকে। আর এতে করে গ্রাহকদের কাছে কোম্পানিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
চীনে বিওয়াইডির ১০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের গাড়িও রয়েছে। অন্যদিকে টেসলার সবচেয়ে কম দামের গাড়ির মূল্যও ৩২ হাজার মার্কিন ডলার।
বিওয়াইডির যাত্রীবাহী গাড়িগুলো এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করেনি। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ায় তৈরিকৃত কোম্পানিটি বৈদ্যুতিক বাসগুলো দেশটিতে বিক্রি করা হচ্ছে।
১৯৯০-এর দশকে প্রকৌশলী ওয়াং বেইজিং ভিত্তিক একটি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাটারি তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। সরকারি লোভনীয় পদের চাকরি ছেড়ে তিনি বিওয়াইডি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯৭ সালের মধ্যে ওয়াং কোম্পানির ছোট কারখানাটিকে একটি মাঝারি আকারের সেলফোন ব্যাটারি তৈরির কারখানায় পরিণত করেন। তখন কোম্পানিটির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার।
২০০৩ সালের মধ্যে বিওয়াইডি নিকেল-ক্যাডমিয়াম ব্যাটারির সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী কোম্পানিতে পরিণত হয়। আর মোবাইল ফোনে এটিই বিশ্বব্যাপী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
তবে ওয়াংয়ের স্বপ্ন ছিল আরও বড়। ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক গাড়ির সম্ভাবনা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ২০০৩ সালে ৩৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিকে কিনে নেন।
তৎকালীন সময়ে ওয়াংয়ের এমন সিদ্ধান্ত খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি বিওয়াইডির কৌশলগত বিনিয়োগকারীরা। এতে করে হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ২১ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়।
তবে নিজের দূরদর্শী পরিকল্পনায় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন ওয়াং। বরং শেয়ারের দাম কমে যাওয়ার পরেও তিনি বলেন যে, "আমি গাড়ি তৈরি করছি কারণ আমি বৈদ্যুতিক গাড়ির ভবিষ্যত উন্নয়নের বিষয়ে আশাবাদী।"
এমন সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের পাঁচ বছর পর, ২০০৮ সালে ওয়াং ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের কাছ থেকে ২৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছিলেন। এতে তিনি প্রায় ১০ ভাগ শেয়ারের জন্য শেয়ার প্রতি প্রায় ১ ডলার প্রদান করেছিল।
এতে করে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য হুহু করে বাড়তে থাকে। বাফেটের বিনিয়োগের এক বছরের মধ্যেই বিওয়াইডির শেয়ারের মূল্য ১,৩৭০ শতাংশ বেড়ে যায়।
২০০৮ সালের শেষের দিকে বিওয়াইডি নিজেদের প্রথম প্লাগ-ইন হাইব্রিড মডেল চালু করে। এতে করে বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রস্তুতকারক হিসেবে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে চীন সরকারের পক্ষ থেকেও বেশ সহযোগিতা করা হয়েছে।
ধনকুবের বাফেট অবশ্য ২০২২ সাল থেকে ধীরে ধীরে বিওয়াইডি-তে তার অংশীদারিত্ব কমিয়ে আনছেন। তবে এর আগে অবশ্য সে বেশ ভালো লাভবান হয়েছেন।
বাফেটের বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের সাম্প্রতিক ফাইলিং অনুসারে, গত অক্টোবরের শেষের দিকে ফার্মটি বিওয়াইডি-এর প্রায় ৮ ভাগ শেয়ারের মালিক। বাজারে যার মূল্য এখন ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিওয়াইডি চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে ২০১৫ সাল থেকেই প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এক্ষেত্রে এটি দেশটির বাজারে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বহু জায়ান্ট কোম্পানিকে পেছনে ফেলেছে। এক্ষেত্রে দামের ব্যাপারটিই মূল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টেসলার মডেল ৩, মডেল ওয়াই, মডেল এস, মডেল এক্সের দাম ৪০ হাজার ডলার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। চীনে সবচেয়ে কমদামী গাড়ি মডেল ৩ এর দাম প্রায় ৩২ হাজার ডলার। এটি এক চার্জে ২৭২ মাইল যেতে পারে এবং ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৪০ মাইল।
অন্যদিকে বিওয়াইডির মডেল সিগাল সর্বনিন্ম দাম প্রায় ২০ হাজার ডলার। এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮১ মাইল। গাড়িটিতে ব্যাটারির দুটি প্যাক রয়েছে। ছোট ব্যাটারিটি দিয়ে ১৯০ মাইল আর বড় ব্যাটারি দিয়ে ২৫২ মাইল যাওয়া সম্ভব।
টেসলা ও বিওয়াইডি উভয়ই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে 'সেইফটি রেটিং' লাভ করেছে। ২০২২ সালে টেসলার মডেল ওয়াই এবং বিওয়াইডি-এর এটটো ৩ যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ান 'নিউ কার অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম' এর কাছ থেকে 'পাঁচ তারকা' রেটিং পেয়েছে।
২০২০ সাল থেকে বিওয়াইডি নিজেরাই লিথিয়াম আয়রন ফসফেট ব্যাটারি (ব্লেড ব্যাটারি) তৈরি করেছে। সেগুলো নিজেদের গাড়িতে ব্যবহারের পাশাপাশি টয়োটার মতো বিখ্যাত কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করছে।
বিওয়াইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের তৈরি লিথিয়াম আয়রন ফসফেট ব্যাটারি প্রচলিত লিথিয়াম আয়রন সেলের তুলনায় পাতলা ও দীর্ঘস্থায়ী। এইভাবে ব্যাটারি প্যাকের মধ্যেকার স্থানটি ব্যবহার এটির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এছাড়াও দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও এটির আগুন ধরার সম্ভাবনা কম।
টেসলাও নিজেদের ওয়াই মডেলের গাড়ির জন্য বিওয়াইডির ব্লেড ব্যাটারি ব্যবহার করেছে। যেটি বার্লিনে অবস্থিত কোম্পানিটির গিগা ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা হয়েছে।
যদিও গত বছরের মার্চ মাসে ইলন মাস্ক জানান, বিওয়াইডি-এর সাথে ব্যাটারি সম্পর্কিত সকল ব্যবসা বন্ধ করছে টেসলা।