মতি মহল: বাটার চিকেন নিয়ে ভারতের দুই পরিবারের লড়াই
বাটার চিকেন মাখন এবং হালকা মশলা সমৃদ্ধ একটি ঘন টমেটো-দইয়ের গ্রেভিতে তৈরি লোভনীয় খাবার যা রহস্য উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি ছাড়াও অগণিত রেস্তোরাঁর অর্ডারকেও অনুপ্রাণিত করেছে৷
কিন্তু মুখরোচক এই তরকারি যা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে একটি পরিচিত ও প্রিয় খাবার তা এখন আদালতে যুদ্ধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে দিল্লি হাইকোর্টে এই খাবারের উৎস নিয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলায় দুটো প্রতিযোগী রেস্তোরাঁ এবং পরিবার জড়িত। উভয় দলই ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত শহরের বিখ্যাত মতি মহল রেস্তোরাঁর মালিকানা দাবি করার পাশাপাশি নিজেদেরকে জনপ্রিয় এই খাবারের উদ্ভাবক বলেও দাবি করেছে।
মূল রেস্তোরাঁর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কুন্দন লাল গুজরালের পরিবারের করা মামলায় তারা দাবি করে, গুজরাল এই খাবারের উদ্ভাবক এবং মিথ্যা কৃতিত্ব নেওয়ার দোষে প্রতিদ্বন্দ্বী দরিয়াগঞ্জের বিরুদ্ধে তারা মামলা করেছেন।
গুজরাল পরিবার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করেছে। তারা এটাও অভিযোগ করেছে, দরিয়াগঞ্জ ভুলভাবে দাবি করেছে তারা মাখন এবং ক্রিম দিয়ে তৈরি একটি মসুর ডালের খাবার আবিষ্কার করেছে যা "ডাল মাখনি" নামে পরিচিত ।
বাটার চিকেন কীভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল তার অসংখ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে সেগুলো সবই শুরু হয় মোখা সিং নামক একজন ব্যক্তি ও তার তিনজন কর্মচারীকে দিয়ে যার উপমহাদেশে অবস্থিত অন্তত তিনটি ভিন্ন রেস্তোরাঁ জড়িত।
শেফ এবং খাদ্য লেখক সাদাফ হোসেন বলেছেন, এই গল্পটি প্রাক-স্বাধীন ভারতে এবং পেশোয়ারের (বর্তমানে পাকিস্তানে) ধুলোময় গলির যেখানে একজন তরুণ মোখা সিং মতি মহল নামে একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ চালাতেন।
১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয়, সিং এবং তার বেশ কয়েকজন হিন্দু কর্মচারী পেশোয়ার ছেড়ে ভারতের রাজধানীতে চলে আসেন। শীঘ্রই তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন।
এতদিনের মধ্যে তারা তিনজন— কুন্দন লাল গুজরাল, তার চাচাতো ভাই কুন্দন লাল জাগ্গি এবং ঠাকুর দাস মাগো একটি অস্থায়ী মদের দোকানে সিংয়ের দেখা পান এবং তাকে দিল্লিতে একটি নতুন মতি মহল রেস্তোরাঁ খুলতে দিতে রাজি করান।
হোসেন বলেন, দিল্লির পুরানো কোয়ার্টারে জনাকীর্ণ দরিয়াগঞ্জের রাস্তায় অবস্থিত এই ছোট্ট খোলামেলা রেস্তোরাঁয় বাটার চিকেনের জন্ম হয়েছিল। এই খাবার তৈরির বুদ্ধি এসেছিল মিতব্যয়িতা থেকে। অবশিষ্ট টিক্কা ব্যবহার করে এবং একটি ঘন টমেটো গ্রেভি ও মাখনের মিশ্রণের থেকে তৈরি এই খাবার বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল।
এক বছরের মধ্যে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সহ মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধানরা মতি মহলে নিয়মিত গ্রাহক হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমস মতি মহল সম্পর্কে লিখেছিল, "রেস্তোরাঁর বারান্দায় শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল। কথিত আছে এম মৌলানা আজাদ ইরানের শাহকে বলেছিলেন যে ভারতে থাকাকালীন তাকে অবশ্যই দুটি সফর করতে হবে, তাজমহল এবং মতি মহল।"
দীর্ঘদিন ধরে কুন্দন লাল গুজরালকে বাটার চিকেন রেসিপি এবং রেস্তোরাঁটির ক্রমবর্ধমান সাফল্যের জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিল।
হোসেন বলেন, "কিন্তু তার মৃত্যুর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৯৭ সালে গুজরাল পরিবার এবং তার অংশীদারদের দীর্ঘ আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পর মতি মহল লিজ দিতে হয়েছিল।"
রেস্তোরাঁটি এখন একটি ভিন্ন পরিবার দ্বারা পরিচালিত হয়।
কয়েক বছর পরে, গুজরালরা একটি আলাদা চেইন চালু করে এবং এটিকে মতি মহল ডিলাক্স নামে ডাকা শুরু হয়। ব্যবসা আবার চালু হয় এবং শহর জুড়ে অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলা হয়।
কিন্তু ২০১৯ সালে তাদের জন্য আরেকটি বিপত্তি অপেক্ষা করেছিল যখন দ্বিতীয় অংশীদার কুন্দন লাল জাগ্গির নাতি,দরিয়াগঞ্জ নামক একটি প্রতিদ্বন্দ্বী রেস্তোরাঁ চেইন খোলেন।
দরিয়াগঞ্জের মালিকরা যুক্তি দিয়েছিলেন, গুজরাল যখন রেস্তোরাঁর প্রধান ছিলেন তখন জাগ্গি রান্নাঘর পরিচালনা করতেন এবং তাই বাটার চিকেন সহ খাবারগুলো ছিল তার বুদ্ধি ।
গুজরালরা অবশ্য এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং দাবি করেছিল, জাগ্গি একজন জুনিয়র অংশীদার যিনি এই মেন্যু তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেননি। বাটার চিকেন আসলে গুজরাল যখন পেশোয়ারে ছিলেন তখনই তৈরি করেছিলেন।
এটি নিয়েই বর্তমানে আদালতে যুদ্ধ চলছে। গুজরালের পরিবার দাবি করেছে, দরিয়াগঞ্জের মালিকদের নিজেদেরকে বাটার চিকেনের উদ্ভাবক বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
মামলা দায়েরকারী কুন্দন লাল গুজরালের নাতি সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, "আপনি কারো উত্তরাধিকার কেড়ে নিতে পারবেন না।"
খাবারের মালিকানা দাবি করা নিয়ে দ্বন্দ্ব এটিই প্রথম নয়। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশা (পূর্বে উড়িষ্যা) এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একটি তিক্ত ঝগড়া শুরু হয়েছিল তাদের মধ্যে কে রসগোল্লা উদ্ভাবন করেছিল সেটা নিয়ে। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) কর্তৃপক্ষ পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে রায় দেওয়ার পর অবশেষে ২০১৮ সালে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেফরাও তাদের রেস্তোরাঁ, রন্ধন শৈলী এবং খাবারগুলোকে রক্ষা করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকারের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও আদালতে এসব মামলা পৌঁছানো এখনও বিরল।
খাদ্য লেখক বীর সাংঘভি বলেছেন, "কিন্তু এই ধরনের বিরোধগুলো সাধারণত বাণিজ্যিক প্রকৃতির হয় এবং গ্রাহকদের সাথে খুব একটা সম্পর্ক নেই। লোকেরা তাদের পছন্দের খাবার খেতে রেস্তোরাঁয় যায় এবং কয়েক দশক আগে কে তাদের আবিষ্কার করেছিল তা সত্যিই চিন্তা করে না।"
মতি মহলের ক্ষেত্রে বিষয়গুলি আরও জটিল হতে পারে কারণ বিরোধটি রেস্তোরাঁটি বাটার চিকেন তৈরি করেছে কিনা তা নিয়ে নয়, এটির মালিকদের মধ্যে কে এটির উদ্ভাবনে বড় ভূমিকা পালন করেছে তা নিয়ে।
সাংঘভি বলেছেন, "এটি দাদার উত্তরাধিকারের জন্য লড়াই করার গল্প এবং এই ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি করা সবচেয়ে কঠিন।"
আইনজীবীদের মতে, আদালতকে 'পরিস্থিতিগত প্রমাণ' এবং কয়েক দশক আগে খাবারটি খেয়েছে এমন লোকদের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু তারপরও বিচারকরা কীভাবে নির্ধারণ করবেন কে প্রথম খাবারটি তৈরি করেছিলেন?
সাংঘভির ভাষ্যমতে, "এটা সম্ভব যে অংশীদারদের একজনের হাতে লেখা একটি রেসিপি ছিল যা সমস্যাটি সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি প্রকাশ্যে আসেনি।"
কিন্তু দরিয়াগঞ্জের মালিকরা জানান যে তারা খাবারটি উদ্ভাবনের বিষয়ে তাদের দাবি প্রত্যাহার করলেও তাদের ব্যবসায় কোনো পার্থক্য হবে না।
সাথে সাংঘভি যোগ করেছেন, দরিয়াগঞ্জের সাফল্য সত্ত্বেও মতি মহলও সমৃদ্ধ হতে থাকবে।
তিনি বলেন, "তবুও এত দিন পরে এটা বলা কঠিন হবে রান্নাঘরে আসলে কী হয়েছিল।"