রুশবাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত ইউক্রেন, নেই পর্যাপ্ত সেনা-গোলাবারুদ
ইউক্রেনযুদ্ধ এর তৃতীয় বছরে পড়েছে। ইউক্রেনের ৫৯ পদাতিক ব্রিগেড এ পর্যায়ে এসে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে: রাশিয়ান আক্রমণকারীদের রুখতে তাদের প্রয়োজনীয় সেনা ও গোলাবারুদ ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে।
'টিগর' ডাকনামে পরিচিত এক প্লাটুন কমান্ডারের অনুমান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ৫৯ ব্রিগেডের কয়েক হাজার সৈন্যের মধ্যে এখন কেবল ৬০–৭০ শতাংশ টিকে আছে। বাকিরা যুদ্ধে নিহত, আহত অথবা বয়স বেশি হয়ে যাওয়া বা অসুস্থতার কারণে সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়েছে।
রাশিয়ান বাহিনীর হাতে মার খাওয়ার পাশাপাশি পূর্ব রণাঙ্গনের কঠিন পরিবেশও ইউক্রেনীয় সৈন্যদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অঞ্চলের মাঠঘাট বর্তমানে বরফগলা কাদায় ডুবে আছে, তার ওপর উষ্ণ তাপমাত্রাও সেনাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
'আবহাওয়ার অবস্থা হলো বৃষ্টি, তুষার, বৃষ্টি, তুষার। এর ফলে সৈন্যরা ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকে, তাদের জায়গায় অন্য কাউকে পাঠানোর জো নেই,' বলেন ৫৯ ব্রিগেডের একটি কোম্পানির কমান্ডার 'লিমুজিন'। 'প্রতিটি ইউনিটের সবচেয়ে আশু সমস্যাটি হলো জনবলের অভাব,' তিনি জানান।
গত সপ্তাহে পূর্ব দনেৎস্কের আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মস্কো। শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চেষ্টা করা ইউক্রেনের ৩ সেপারেট অ্যাসল্ট ব্রিগেডের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের প্রতিজন সৈন্যকে সাতজন রুশ সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল।
পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের এক হাজার কিলোমিটার রণাঙ্গনের পদাতিক, ড্রোন ও গোলন্দাজ বাহিনীর ২০ জনের বেশি সৈন্য ও কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স।
ইউক্রেনীয় সৈন্য-কমান্ডারেরা এখনো রাশিয়ান দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়তে উদ্বুদ্ধ থাকলেও তারা সুসজ্জিত ও বৃহৎ রুশ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন। বর্তমানে পশ্চিমামিত্রদের কাছ থেকে আগের মতো অস্ত্র ও রসদের সরবরাহ পাচ্ছে না ইউক্রেন।
৫৯ ব্রিগেডের রিওরি নামক এক কমান্ডার বলেন, পাঁচ–সাতজনের এক-একটি রুশ সেনাদল তাদের ওপর একসঙ্গে আক্রমণ চালায়। তারা দিনে ১০ বারও সামনের দিকে অগ্রসরের চেষ্টা করে।
এ ধরনের ছোটদলকে থামিয়ে রাখতে তাদের বিরুদ্ধে প্রায় অব্যাহত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় ইউক্রেনীয় সেনারা। 'যখন একটি বা দুইটি প্রতিরক্ষাদল সারাদিন এ ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে পালটা জবাব দিতে ব্যস্ত থাকে, তখন সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে,' বলেন কমান্ডার রিওরি।
ইউক্রেনীয় সৈন্যদের অস্ত্রগুলোও মাঝেমধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে। 'তাদের জন্য আরও গোলাবারুদ আনা বা তাদের অস্ত্রগুলো বদলে দিয়ে নতুন অস্ত্র সরবরাহের কোনো সম্ভাবনা যদি না থাকে, তাহলে বুঝতে পারছেন আমাদের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে,' রয়টার্সকে বলেন এ কমান্ডার।
যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও অস্ত্র দুটোর জন্য বিদেশি সহায়তার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল ইউক্রেন। কিন্তু ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক চক্করের ফাঁকে পড়ে ৬১ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তা বর্তমানে আটকে আছে। তাই রুশ আক্রমণ শুরুর পর থেকে এ প্রথমবারের মতো এতটা বিপদগ্রস্ত বোধ করছে ইউক্রেনকে।
জিআরএডি রকেট আর্টিলারি ইউনিটের এক সৈনিক জানান, সোভিয়েত নকশার গোলা ব্যবহার করা তার রকেট লঞ্চারটি বর্তমানে সর্বোচ্চ সক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। 'সম্প্রতি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন আর তেমন বেশি বিদেশি গোলা পাওয়া যাচ্ছে না,' বলেন তিনি।
পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গোলার জোগান দিতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ স্থগিত রেখেছে, অন্যদিকে ইইউ জানিয়েছে, এটি আগের প্রতিশ্রুত লাখ দশেক গোলার কেবল অর্ধেকের মতো আগামী মার্চের মধ্যে সরবরাহ করতে পারবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো ও রুশ সামরিক বাহিনী বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান অনুমান করেন, রাশিয়ার গোলন্দাজ বাহিনী বর্তমানে ইউক্রেনের বাহিনীর চেয়ে পাঁচগুণ বেশি গোলা নিক্ষেপ করছে। কমান্ডার রিওরি'র অনুমানও তা-ই বলছে।